West Bengal Lockdown

এত মানুষ কোথায় বেমালুম গায়েব হল, বিস্ময়ে হতবাক রুদ্ধনগরী

কোথায় গেল মিনিবাসে বাদুড়ঝোলা ভিড় কিংবা মেট্রো রেলে প্রজাপতির মতো মেয়েরা? সবাই যেন উবে গিয়েছে। পাড়ায় সবাই ভাইরাস-বিশেষজ্ঞ কিংবা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। বান্ধবী ভিডিয়ো কলে নারাজ। বর বাড়িতে আছে বলে নয়, তার ভুরু প্লাক না করে শোচনীয় হয়ে উঠেছে বলে! ভরদুপুরের হাইকোর্ট চত্বর, পোদ্দার কোর্ট, ক্যানিং স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গি--- যাকে হিড়হিড় করে টেনে সেঁকো বিষ খাওয়াতে চেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তা এখন একান্তই অলীক।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২০ ০০:০৪
Share:

কলকাতার বিষয়ে কয়েকটি কথা আমি আগেই জানতুম। আর কয়েকটি কথা সদ্য জেনেছি। যেমন সরস্বতী পুজোর দুপুরের মেট্রো, পার্ক বা বইমেলা যারা ফুলের সমারোহে রাঙিয়ে তুলত শাড়িতে, যা মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উবে যাবে বচ্ছরকার মতো, তারা আসলে সত্যি কোনও নারী নয়, ভূত! এ কথা এখন অনেকেই জানেন। কিন্তু তা বলে বেলগাছিয়ার মিল্ক কলোনি বা কসবা বোসপুকুর স্ট্যান্ডে পরিত্যক্ত এত দিনের ধুলো-ঘাম মাখা মুড়ির টিন বাস থেকে উধাও মানুষগুলোও যে অশরীরী, সে আমার জানা ছিল না।

Advertisement

লীলা মজুমদারের গল্পে তেপান্তর পারের সেই বাড়িটা প্রোমোটিংয়ের জন্য ফাঁকা করতে ভূতেদের সঙ্গেই রফা করতে হয়েছিল। উদ্বাস্তু ঘর না কোথাকার সব হাড়হাভাতে ছেলের পাল! গরম ভাতের আশায় দোরগোড়ায় মরে ভূত হয়ে মহা টেঁটিয়াগিরি শুরু করেছিল! তেনাদের জন্য টিফিনের কচুরি, আলুর চাট, জিবেগজাটজা সব গচ্চা

দিতে হল। চুপড়ি খুলে খাবলা-খাবলা খাইয়ে তুষ্টু করে তবে শান্তি! আহিরীটোলার গঙ্গাপাড়, ভবানীপুরের পরিত্যক্ত ছাদ বা চেতলার তস্য গলির পোড়ো বাড়িতে বড় ঘরের পাঁচ-ছ’পুরুষ পিছনের স্বর্গগত বুড়ো কর্তা যে ঠাকুর-চাকর নিয়ে থাকতে পারেন, সে-কথা সর্বজনবিদিত ঠিকই, তা বলে একটা গোটা শহর, অফিস-রেস্তরাঁ-শপিংমল-স্টেডিয়াম-কারখানা, বাসট্যাক্সিঅটোর ঘেঁষাঘেঁষি-ঠাসাঠাসিও ‘সব ঝুট থা’ (বা ভূত থা), তা সত্যিই বুঝে উঠতে পারিনি।

Advertisement

ভরদুপুরের হাইকোর্ট চত্বর, পোদ্দার কোর্ট, ক্যানিং স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গি--- যাকে হিড়হিড় করে টেনে সেঁকো বিষ খাওয়াতে চেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তা এখন একান্তই অলীক। জনহীন রাসবিহারী, টালিগঞ্জ, হাওড়া ব্রিজ, শ্যামবাজারের দিকে চেয়ে মনটা হু-হু করছে, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। পাণ্ডববর্জিত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে সন্ধে নামতেই ঘুমিয়ে কাদা জটাধারীর পেট্রোল পাম্প। সোনাগাছির মেয়েরা কি তবে উবে গেল? হিজড়ে ভিখারিশূন্য ট্রাফিক সিগন্যাল... হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন। চৈত্র সেলের সেই হাঁকাহাঁকিময় ঘামের গন্ধ ভরা জলজ্যান্ত গড়িয়াহাট কিংবা নববর্ষে গিলে করা পাঞ্জাবি, সন্দেশ-শরবতময় বইপাড়ার সাহিত্যবাসর... সব কোথায় গেল! ড্রোন নিয়ে এরিয়াল শটে নাগরিক স্কাইলাইনে চোখ রেখে আকাশকেই রাস্তা মনে হয়। টি এস এলিয়ট বলে ওঠেন, ‘আ ভিশন অব দ্য স্ট্রিট অ্যাজ় দ্য স্ট্রিট হার্ডলি আন্ডারস্ট্যান্ডস।’ তা হলে তো সব মিথ্যে, এত লোক ভূতই ছিল, বলুন! ভূতের মতো এক ভাইরাস যা অনেকটা ফুলকপির বড়ার মতো দেখতে, কিন্তু চোখে দেখা যায় না, চিনিয়ে দিয়ে গেল। নইলে এ কি সম্ভব, এত মানুষকে বেমালুম পেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেলা...

এ পর্যন্ত লিখে ফেলেই রবিবাসরীয় বাজারের ভিড়াক্কার ছবিটাও চোখে ভাসছে। না, সল্ট লেকের অমুক ব্লকে যাঁরা থাকেন, তাঁদের ফ্ল্যাটে জায়গার অভাব ছিল না। তবু নিষেধ উড়িয়ে সাতসকালের বাজারে সক্কলে দল বেঁধে হামলে পড়েছেন। এ বড় সত্যি কথা, ‘জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে’। ভিডিয়ো কলে নয়ডার বন্ধুটি নবরাত্রিতে মাছের অভাবে হাহাকার করছিল। বেঙ্গালুরু বলছিল, পনির কিনতে পুলিশের তাড়া খাওয়ার গল্প। দশ দিন কি দু’হপ্তায় আবাসন ক্যাম্পাসে মাছের গাড়ি আসা মানে এখন উঠোনে গোপন ফ্যান্টাসির অধিষ্ঠান। তবু মিনেসোটায় বন্ধুনির ভরপুর সেলারের দিকে তাকিয়ে হালকা কুনজর দিচ্ছি, ঠিক তখনই বেরসিকের মতো তালতলার নুরভাইয়ের ফোনটা আসে। উ-ফ কী যে এত বাড়ি ফেরার তাড়া! লকডাউনের প্রথম দফার মেয়াদ বাড়ার আগে নুর ট্রেনে না প্লেনে দু’খেপে কাশ্মীর ফেরার অনলাইন টিকিট কেটে পুরো জলে পড়েছেন। উড়ান-টুড়ান সব বাতিল। এ দিকে গলে গিয়েছে আট হাজার টাকা। এখন ফেরতও দিচ্ছে না। পরে ফের টিকিট হলে শোধবোধ হবে। ঘরে ফেরার মরশুমে সময় মতো ফিরতে না-পারা, অতএব ভূস্বর্গের শালওয়ালা নুরের খোরাকিতে টান পড়েছে। এ শহরে অতিথি হিসেবে বরাদ্দ রেশন বাবদ (এ লেখার সময় পর্যন্ত) মেরেকেটে তিন কিলো চাল ও আটা পেয়েছেন ওঁরা। ভাড়ার ঘরে থাকেন চার জন। থাকা, খাওয়া, যাওয়া সবই অনিশ্চয়তায় মোড়া। ডালমুটের সান্ধ্য চাখনায় মুখ চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলার সময়ে লজ্জা করে। যদি চিবোনোর শব্দ কানে যায়, কী ভাববে...

সব সমস্যার সমাধান করার থেকে বরং ঢের সহজ হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে কোন পাড়া নিয়ম মানছে না, আর সরকার কী কী ভুল করল, তা নিয়ে সেমিনার বসানো। আমাদের সবার বন্ধুমহলে এখন ভাইরোলজিস্ট, এপিডিমিয়োলজিস্ট, মায় পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট কাম ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্যোতিষীও মজুত। বারমুডা পরে পাড়ার বাজারে বসে নাক চুলকে চুলকে এখনও ‘পাবলিক কিন্তু কথা বুঝছে না’ বলে অটুট অক্লান্ত বিজ্ঞ ভাব। ইংরিজি থেকে সংস্কৃতে করোনা তাড়ানোর হোয়াটসঅ্যাপ মহামন্ত্র জপছি। ঠাকুর রক্ষে করো। যাক, ভূতুড়ে ভাইরাস তা হলে এ ভাষাদু’টো বোঝে।

ধুস কী সারা ক্ষণ ভূতের কথা, খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন একটা পজ়িটিভ ভাইব দরকার। সব খারাপেরই তো কিছু ভালও থাকে। এ তো সেই ভালকে ছেনে নেওয়ার সুযোগ। পরিবারকে সময় দিন। সবাই মিলে বসে কিছু ভাল সিরিজ় দেখুন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাঁধুন, বাসন মাজুন। নেড়েচেড়ে ডালগোনা কফিটা অন্তত করুন। ছাদে, বারান্দায় হাল্কা লম্ফঝম্প করুন, ক্যালরি পোড়ান। না, করবেন না (মানে আড়ালে করবেন), উল্টো দিকের পড়শি বিভ্রান্ত হতে পারেন। হয়তো জানতে চাইবেন, আচ্ছা এটা কি তিনি আজ সকাল দশটায় করতে বলেছিলেন?

বলা হচ্ছে, ‘বি সি’ বলতে এ বার থেকে আমরা প্রাক বা ‘বিফোর ক্রাইস্ট’-এর বদলে ‘বিফোর করোনা’ বুঝব। এটাই নতুন যুগের সূচনা। আমরা জানি, সব মহামারির পরেই এমন ঘটে পৃথিবীর। এই যে দেখুন না, মিষ্টির দোকানে এখনও একটু ভিড় হচ্ছে ঠিকই তবু খুচরো বিপণিতে কেমন চমৎকার গোল ঢেরার মধ্যে দাঁড়িয়ে দূরত্ব রেখে টপকে টপকে এগোচ্ছি। প্যারিস থেকে পুরুলিয়া, সর্বত্র এ ভাবেই চলছে ছবিও দেখছি। পোস্তায় মুটেদেরও একই ভাবে ব্যবধান রেখে পুলিশ যত্ন করে খাওয়াচ্ছে, ছবি বেরিয়েছে। ব্যাখ্যা, ওই ভাবে পারস্পরিক দূরত্ব না বাঁচালে মহা বিপদ। মুটেদের করোনা হওয়ার অধিকার নেই। হলে কে সামলাবে, কেই বা ভ্যানে করে আনাজ, কাঁচামাল জায়গা মতো ডেলিভারি দেবে। ঠেকায় পড়ে এই মানবিক অধিকার প্রদানের ছবিটুকু দেখে এত বিপদেও হাসি পায়। পার্ক সার্কাসের রেলরাস্তা, পিজি হাসপাতাল পাড়া, শোভাবাজার, নিমতলায় এখন দূরত্বশৃঙ্খল বজায় রাখা ফ্যাতাড়ুর ঝাঁক। খিদে পেটে খিচুড়ির গন্ধ মাস্ক-আঁটা নাকে ঢুকলে কিন্তু নিজেকে সামলানো কঠিন।

তবু শহরটাকে এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ সংহতিতে দেখলে ভূত দেখছি বলেই মনে হয়। বীভৎস ভূত আয়নাতেও মুখোমুখি। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলে পাগলপারা উস্কোখুস্কো নিজের দিকে তাকাতে পারি না। ভাগ্যিস গোপন ভিডিয়ো কলে আসতে রাজি নয় চুমকি! বাড়িতে বর থাকাটা বড় কথা নয়! ওর আইব্রাওয়ের দশা না কি শোচনীয়! মনে মনে বলি, বাঁচা গিয়েছে। চেহ্‌রা কেয়া দেখতে হো...কণ্ঠ বিরহব্যথাতুর করে তুললেও জানি বইকি, এ সময়ে দেখা দেওয়াটা সু-বিবেচনা হত না।

উত্তর ভারতের কয়েকটি শহরে রাজপথে নীলগাই দেখা গিয়েছে, উত্তেজনা। বেথুয়াডহরি থেকে ময়ূর, হরিণেরা এখনও কলকাতায় ঢুকে পড়েনি ঠিকই, তবে হাওড়ার অধ্যাপিকা বন্ধুর অনলাইন ক্লাসে পড়া বুঝতে জনৈক ছাত্রীর বাবা চলে এসেছিলেন। দুপুরের এঁটোকাঁটা গুছিয়ে ডাকলেও কাক, বেড়ালদের আসতে দেরি হচ্ছে। হয়তো আর একটু সক্রিয় সশব্দ তল্লাটের খোঁজেই তারা বেপাড়ায়। তবে বেলা দশটায় ফ্ল্যাটের আনাচে-কানাচে পাড়াগেঁয়ে পাখির ডাক সত্যি চমকে দিচ্ছে। বাজারে জোর গুজব, মুম্বইয়ে মেরিন ড্রাইভে ডলফিন, শ্যামবাজার নিদেনপক্ষে বারাসত থেকে এ বার কাঞ্চনজঙ্ঘাও নিশ্চিত দেখা যাবে। বলা যায় না, আগামী বর্ষায় দূষণমুক্ত কলকাতার গঙ্গায় ইলিশের ভূতও হয়তো ফিরে আসবে। পয়লা বৈশাখটা যেমন তেমন করে কাটল! তবে আর দেড়-দু’মাসে আলবাত রজতকান্তি মৎস্যকুলতিলককে হাতে ঝুলিয়ে ঠিক দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘরে ফিরব। যেমন গত শতকেও একদা ফিরতেন অনেকে। অবশ্য রোজই পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। আরও মাস দেড়েকের ধাক্কায় মন্দার বাজারে কোন ইন্দ্রপতন অপেক্ষা করে আছে, কে জানে!

তবু এখনও পর্যন্ত এই জাতির আশাবাদের তারিফ না-করেই বা কী উপায়! বয়স্কদের বাড়িতে ওষুধ সরবরাহের হেল্পলাইন সার্ভিস খুলে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু তরুণ। তাঁদের নম্বর নিয়ে রসিক বাঙালি দোরগোড়ায় মদ্য পরিষেবা নামে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দিয়েছে। করোনার থেকেও দ্রুত গতিতে খবর ভাইরাল। ফলে ফোনে ফোনে নাজেহাল সেই যুবকেরা। সাহায্যের আসল চেষ্টাটাই লাটে উঠল। ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’, তাই এ আকালে যাই ঘটুক যেন দু’পাত্তর পেটে নিয়েই মরি।

সে-দিন একরত্তি, কোনও প্রবীণের ঘোলাটে স্মৃতিতে সত্যি হানা দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্ল্যাকআউট কিংবা মন্বন্তরের ছবি। এখন যেমন পাশের ফ্ল্যাটের সঙ্গে কথা বললেই মুখে ওড়না চেপে নেওয়া বা বাজারসুদ্ধ বাড়ি ফিরেই ব্যাগ, মোবাইলে স্যানিটাইজ়ার লেপে নিজেকে অস্পৃশ্য জ্ঞানে কলঘরে ছোটার ড্রিল, তখন সাইরেন বাজলেই খুদেদের কাঁধে-পিঠে নিয়ে পড়ি-কি-মরি করে সিঁড়ির নীচের চাতাল বা কয়লার ঘরে ছুটতে হত। বোমার ভয়ে ইরাকে সিরিয়ায় যেমন বাঙ্কারে সেঁধিয়ে যাওয়া। সাইরেন ক্লিয়ার হলে ফের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখা যেত হাওড়ার ব্রিজ থেকে অভয় বেলুন ভেসে আসছে। ৯৫ বছরের সুশীল চট্টোপাধ্যায় ওরফে নকুবাবুর স্পষ্ট মনে আছে হাতিবাগান বাজারের সেই বোমা-কাণ্ড। শ্যামবাজারের শ্যামচাঁদ মিত্র লেন থেকে পরের দিন সকালে কী অবস্থা তা দেখতে গিয়েছিলেন পনেরোর কিশোর।

সে-কলকাতা ছে়ড়ে তখন প্রাণভয়ে কর্মাটাঁড়, মধুপুরে পালাচ্ছে গেরস্ত বাঙালি। ঠিক পরেই মন্বন্তরে শহুরে গলির বাতাস ভরে শুধুই ‘ফ্যান দাও’ আবহসঙ্গীত। রাজপথে এক বাটি দুধ নিয়ে মা ও দুই শিশুর খণ্ডযুদ্ধ। দাঙ্গা-দেশভাগোত্তর শহরে

এর পরে কখনও কৈলাস বোস স্ট্রিটের উঠোন রাতারাতি সাতক্ষীরা, খুলনা, নোয়াখালির সমাগমে ভরপুর। কল-পায়খানা থেকে দুর্লভ ডিমসেদ্ধ ভাগাভাগির টানাপড়েন।

কোন অবস্থাটা ভাল ছিল তা বোঝা, বলা শক্ত। তবে এখন বিচ্ছিন্ন হয়েও হাতের মুঠোয় বিশ্বপরিস্থিতি, আগে যা ছিল না। মাঝেমধ্যে অসহ্য দুর্বহ লাগে এই নিরাশ্রয় তথ্যের কঙ্কালভার। গুহামানবের মতো তাই ঘরে ঘরে বাজারের ফসল সাঁটানো চলে। সঙ্গে অতীতচারিতা, সেই দুর্দিনে কী করে এক চিলতে শুঁটকির কাই থালার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সুড়ুত করে সরিয়েই এক থালা ভাত খেয়ে ফেলতেন কলোনির কাকিমারা। ঘরে ঘরে সশ্রম বন্দিত্বের হেঁশেলে কৃৎকৌশলের নানা স্বাক্ষর। কী ভাবে বাসি রুটি টুকরো করে একটু ফুলকপির সঙ্গে ভেজে নিলে রুটির চাউমিনের মতো সুস্বাদু জলখাবারের সংস্থান হয়, কিংবা আনাজ মেশানো সুপের থকথকে ডালটা শুধু খেলেও পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান মেলে— চলছে জল্পনা। অতীতের কাছে পাঠ নিয়ে সম্ভাব্য সঙ্কটের জন্য মহড়া। আর সঙ্কটই যাঁদের বারোমাস্যা? টালাপার্ক লাগোয়া ঝুপড়ির খাদিজা বলছেন, ‘‘আয়লার সময়ে কিন্তু সোমস্যা আর একটু বেশিই ছিল দাদা। এখন তাও এক বেলা খাচ্ছি। তখন সন্দেশখালি থেকে কলকাতা আসা ইস্তক দানাটি দাঁতে কাটিনি। গাঁয়ের কত মেয়ের তখনই ইস্কুলের পাট ঘুচে বিয়ে হল। দূরে দূরে কে কোথায় ছিটকে পড়ল!’’

আমাদের রক্তাক্ত হিংসাগাথায় কখনও প্রাণ বাঁচাতে মানিকতলা আশ্রয় নিয়েছে রাজাবাজারে, লিন্টন স্ট্রিট চলে গিয়েছে নিউ টাউন। সামাজিক দূরত্বের কথা শুনে তাই হালকা হাসিই পায় কলকাতার। বিচ্ছিন্নতা আমাদের শেখানোর দরকার নেই। রাতের অমুক লেন, তমুক চক বা প্লেস তবু রাত-শেষে হঠাৎ ঘুম চোখে গলির মুখে ব্যারিকেড দেখে। ‘অতি স্পর্শকাতর’ তকমায় টোটাল শাটডাউনের অবরোধ। কানাডা দূরে থাক, করিমপুর থেকে কেউ এসেছে শুনলেও এখন ত্রস্ত পাড়া। তবু নৌকো বা গাছের ডালে কোয়রান্টিনের সুযোগ নেই নগর-জীবনের। উবে যাওয়া মানুষগুলো সব চার দেওয়ালের ভেতরেই সেঁধিয়ে। ঘরে আট জনের ঘেঁষাঘেঁষি, একটানা কাশির ঘংঘং। তবু গলিতে ভ্যানরিকশার পিঠে একলা ঘুমোনোর আর সাহস হয় না অজ গলির তরুণের। তারও হাসি পায়, কে জানে ঘরে না বাইরে কোথায় বিপদ বেশি!

ফি-রবিবার কাকভোরে টেরিটিবাজারে ধূমায়িত সুপ-মোমোর পশরা সাজানোর আগে পাউচে সয়া সস ভরতে ব্যস্ত চিনা বৃদ্ধকে কত দিন দেখিনি! পার্ক সার্কাসের সিএএ-বিরোধী অবস্থানের মাঠে গলা ফাটিয়ে স্লোগানে মাতানো তরুণী শুনেছি বেনেপুকুরের পাড়ায় সব-হারাদের সাহায্যে ভরসাস্থল। পুলিশের লক-আপে ঘেঁষাঘেঁষির ভয়। লালবাজার দিনের পর দিন বন্দিশূন্য প্রেতপুরী। ফিয়ার্স লেনের কাবাব গলিতে আচম্বিতে

আমার হাত থেকে প্লেট ছিনিয়ে নিয়েছিল বুভুক্ষু ভিখিরি। তার মুখ চোখে ভাসে। গাঢ় হয় ক্ষুধার ইতিহাসের ছায়া।

যামিনী রায়ের একটা ছবি খুব ঘুরছে ফেসবুকে। কলকাতার জনহীন নিকোনো গলির আলো-ছায়া। দেখলে কিন্তু ভেনিস মনে হয়। শূন্যতার শহরকেই তবু ছুঁয়ে যায় বিকেলের হলদে আলোর বৃষ্টি, ট্রামলাইনের সঙ্গে কথা বলে বছরের উজ্জ্বলতম চাঁদ। দুপুর রোদের পগেয়া পট্টি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটই এখন জীবনানন্দের কবিতার রাত। সার-সার পরিত্যক্ত ট্যাক্সির শরীর জুড়ে জানলা-দরজা-খিলান-কপাট-ট্রামলাইনের দিনশেষের শ্রান্তি। শেষ বিকেলের হাজরা মোড়ে অর্ডারের ফাঁকে জিরিয়ে নেয় জনা ছয়েক মাস্কধারী খাবার ডেলিভারি বয়। ফোনে বান্ধবীর সঙ্গে চ্যাট চলে নাগাড়ে। আবহে দু’-একটা অ্যাম্বুলেন্সের বাঁশি। কোনটা মৃত ও জাগ্রত পৃথিবী, কে জানে! তবে টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা।

ভূতুড়ে আর্ট ডেকো বারান্দায় গণেশ পাইনের ক্যানভাসের নারীর মতো অভিজাত অদম্য ভঙ্গিতে উঠে আসে আবহমান কলকাতা, যার চোখ ভরা চরাচরের অন্ধকার। এ দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান, জন্ম লভিবে কী বিশাল প্রাণ তা সবটা স্পষ্ট হতে চায় না। তবে লীলা মজুমদার বলে গিয়েছেন, ভূতেদেরও খুব খিদে পায়। লুচি-সন্দেশ বা গরম ভাতের জন্য তাদেরও মন কেমন করে।

এই কানফাটা নৈঃশব্দ্য কলকাতাকে সে কথাই

বলে চলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement