কিংবদন্তি: মান্না দে।
এক বার জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর সপাট তান আর অলঙ্কারসমৃদ্ধ রাগপ্রধান গানে ঢুকে পড়ল রবীন্দ্রনাথের ‘অল্প লইয়া থাকি তাই’ গানটি। এ গান তিনি রেকর্ড করবেন। কিন্তু তান-কারুকাজসমৃদ্ধ সে গানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই সায় দেননি। বিশ্বভারতীর অনুমোদন না পেয়ে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গোঁসা হলেও দমবার পাত্র নন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গিয়ে দরবার, ‘অল্প লইয়া’-তে রবিঠাকুরের যে সুর, তার উপরে কথা বসিয়ে দিতে হবে। স্বভাবকবি নজরুল লিখে দিলেন, ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর’। গালগল্প তৈরি হতে সময় লাগেনি, এ গান নাকি তিনি লিখেছিলেন পুত্রশোকে। বলামাত্র যে ফরমায়েশি গান লিখে দিলেন, সে নিয়ে জ্ঞান নেই, প্রশংসা দূরস্থান। পাশাপাশি ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম’-এর নজরুল-কৃত লোকসঙ্গীত-আশ্রিত আসল সুরটি মুছেই ফেলা হল। পুনরুদ্ধারের দায় অনুভব করেননি গবেষকেরা। পঞ্চকবির গান সম্পর্কে গড়পড়তা শ্রোতা ওয়াকিবহাল, কিন্তু সুর বা বাণীর শুদ্ধতা নিয়ে সেই সচেতনতা কোথায়? অবহেলার ছবি ঠাকুর পরিবারেও। রবীন্দ্রনাথের ১৮৮১-৮২’র রচনা ‘কালমৃগয়া’ আর ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-র সুরকার যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বরলিপি গীতিমালা’-র আদি সংস্করণগুলিতে তার উল্লেখ থাকলেও এখনকার বিশ্বভারতীর স্বরলিপিতে তা লেখা নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তখনকার বিদেশি সুর-ভাঙা নাট্যসঙ্গীতেরও সংরক্ষণ হয়নি।
গানের ভুবন উদাসীনতায় ছেয়ে। নইলে ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন’, প্রণব রায়ের এই কাব্যগীতি নজরুলের গান হিসেবে চলল কী করে? প্রণব রায় ছাড়াও এ গানের অন্য স্থপতি কমল দাশগুপ্ত যে জড়িয়ে আছেন ফিরোজা বেগম, কানন দেবী, জগন্ময় মিত্রর মতো শিল্পীর উত্থানে, সে কথা ঢাকা পড়ে গেছে শিল্পীদের গানের গরিমায়। বাবু-সংস্কৃতির আগে-পরে রবীন্দ্রনাথকে না চিনে ‘রবিবাবুর গান’ গেয়েছেন যাঁরা, তাঁরা না পেয়েছেন সঠিক বাণী, না সুর বিষয়ে অভিভাবকত্ব। ঠিক সুর পেলে কে মল্লিক, গহরজান, ইন্দুবালা, বেদানা দাসীদের মানের শিল্পীরা সুবিচার করতে পারতেন এ গানে। রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা কাছে পাননি। এ কালের বিশিষ্ট শিল্পী ও সঙ্গীত-আয়োজকদের কাছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমূহ সৃষ্টি সুলভ— রেকর্ডে, স্বরলিপিতে। তবু এঁরা নির্বিচারে আপন মনের মাধুরী মেশান। গান চেনা যায় না, চিনে ফেললে হতে হয় অধোবদন।
ষোলো বছর বয়সে অডিশনে নির্বাচিত হয়ে গ্রামোফোনে রেকর্ড করতে এসেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। কিশোরের জন্য বরাদ্দ হল জীবনসায়াহ্নের গান ‘যদি ভুলে যাও মোরে জানাবো না অভিমান’। রেকর্ডিংয়ে গানের অভিব্যক্তি আনতে প্রাণান্ত শিল্পীর, আর থাপ্পড় চলছে সঙ্গীত পরিচালক সুবল দাশগুপ্তর। এ কালে হলে আদালত পর্যন্ত গড়াত। কলেজ স্ট্রিটের সিসিল হোটেলে বসে সত্তরোর্ধ্ব ধনঞ্জয় বলেছিলেন, সে চড় ছিল আশীর্বাদের মতো, মাস্টারমশাই ও ভাবে না শেখালে কিছুই হত না আমার। পাশাপাশি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ লিখে শুধু শ্রোতাদের কেন, এ গান গেয়ে লক্ষ কোটি মানুষ জাগানো শিল্পীদের সহানুভূতিও পাননি। তাই শেষ জীবন নিরাপদে কাটেনি ওঁর। সুবলবাবু, শিবদাসবাবুর সময়ে গীতিকার-সুরকারদের সম্মান বা সাম্মানিক নিয়ে কে আর মাথা ঘামালেন? সে জন্যই সম্ভবত শচীন দেব বর্মণ মুম্বই যেতে দ্বিধা করেননি। বুঝেছিলেন, ত্রিপুরার যুবরাজ গাইয়ে হিসেবে শ্রোতার মন ভেজালেও পকেট ভরবে না, নামও ছড়াবে না। পরে এই ধারা অনুসরণ করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরী। নচিকেতা ঘোষ কিন্তু মুম্বইয়ে মানিয়ে নিতে পারেননি।
প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত দাস, কাজী নজরুল কাননবালার জন্য গান লিখলেও, সে সুর ও বাণী নিয়ে সে কালের সংবাদমাধ্যমে বিশেষ কিছু শোনা যায় না। অনেকেই জানেন না, মান্না দে-র ‘তোমার শেষ বিচারের আশা’-র গীতিকবি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়! তারাশঙ্করের ‘কবি’ ছবিতে রবীন মজুমদারের কণ্ঠ বাঙালির অন্তঃপুরে এনেছিল তুফান। ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ ক্যানে?’-র সুরকর্তা যে অনিল বাগচী, তিনিই যে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-র ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’র সুরকার, ক’জন মনে রেখেছেন? সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’-র স্থপতি অনুপম ঘটককে মনে রেখেছেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা, আর মুষ্টিমেয় ক’জন শ্রোতা। আর মিলটু ঘোষ? ‘চৌরঙ্গী’ ছবির ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’ গানটি বাদ দেওয়ার তোড়জোড় চলছিল। এডিটরের টেবিলে গীতিকার মিলটুবাবু আর নবীন সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধ এড়িয়ে গান ছেঁটে ফেলার ব্যবস্থা যখন পাকা, উত্তমকুমার ও মান্না দে-র প্রতিবাদে সে গান রাখা হয়। বাকিটা ইতিহাস। কিন্তু অসীমা দেবী এবং মিলটুবাবুর খোঁজ ক’জন রেখেছেন? পিন্টু ভট্টাচার্যের কাছে শোনা, ‘এই রাতদুপুরে দুষ্টু বাঁশি বাজে’ গানের অন্তরার শেষ অংশটি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের অপছন্দ ঠেকল রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে। ‘এবার চুপটি করে ঘরের কপাট খোলো, দ্বারের টিয়া তাকেই শুধু বোলো’, লেখা হয়েছিল। গৌরীপ্রসন্নবাবুর মনে হল, দু’বার ‘তাকেই শুধু বোলো’-র বদলে ‘এ কী আমার হল’ জুড়লে বেশ হয়। যাদবপুর থেকে বাসে বাসে তিনি পৌঁছলেন দমদমের এইচএমভি-তে, বেশ বেলার দিকে। রেকর্ডিং শুরু প্রায়, হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে পিন্টু ভট্টাচার্য ও নচিকেতা ঘোষকে বলে একটি লাইন জুড়লেন। এই দায়বদ্ধতা এখন কোথায়?
সলিল চৌধুরীর করা ‘মর্জিনা আবদাল্লা’র গান ‘বাজে গো বীণা’। গায়ক মান্না দে। সে গানে সেতারের দু’-তিনটে অনবদ্য অংশ আছে যা নাচের মুদ্রার সঙ্গেও মিলবে, মিলবে ছবির নাটকে। কঠিন স্বরলিপি। কলকাতার এক স্টুডিয়োয় দিনভর কাজ করেও সলিলবাবুকে কেউ তুষ্ট করতে পারলেন না। রেকর্ডিং মুম্বইতেই করতে হবে, এমন ভাবনার মধ্যে এক সহযন্ত্রীর আহ্বানে সেখানে হাজির হলেন দীনেশ চন্দ্র। বিস্মৃতপ্রায় সেতারবাদক। এক বার শুধু নোটেশন পড়ে মনে মনে সাজিয়ে নিলেন, এক বারেই গোটাটা নিখুঁত বাজালেন। বিস্মিত সলিল চৌধুরীকে দীনেশবাবু বলেছিলেন, “এই কম্পোজ়িশন মুখস্থ না করলে বাজানো যাবে না। দেখে দেখে বাজানো হচ্ছিল বলেই কেউ পারছিলেন না।” এই দীনেশ চন্দ্রকে কেউ চেনেন না। বাংলা গানবাজনার ইতিহাসে সহযোগী যন্ত্রশিল্পীদের কথা আর কে মনে রেখেছে? দীনেশবাবুরা নীরবে গানের শরীর গড়ে দিয়ে গেছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’ শেখাচ্ছেন সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত সবিনয়ে বললেন, গানের মিউজ়িক উনি করতে চান। বৃন্দবেহালায় গানের মাঝে পায়রাদের ডানা মেলার যে ছন্দ এনেছিলেন সুধীনবাবু, তাকে গান থেকে আলাদা করা যায় না। স্বর্ণযুগের এক-একটি গান তাই সাক্ষাৎ কর্মশালা।
সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরী।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শোনা, সলিল চৌধুরী গান তৈরি করতে কখনও কখনও বেশ সময় নিতেন। দেবব্রত বিশ্বাসের ‘ওহে সাবধানী পথিক’ বারংবার শুনে শেষে তৈরি হল দুই ফলার তরবারি— ‘পথে এবার নামো সাথী’ আর ‘পথ হারাবো বলে এবার’। হয়তো এক সময় রচিত নয়, কিন্তু ভাবতে ভাল লাগে, সলিলবাবুর ভাবনা ছিল— রবীন্দ্রনাথ জীবনপুরের পথিককে সাবধান করে দিচ্ছেন, খানাখন্দে ভরা জীবনপথে ওহে পথিক, সাবধানে হেঁটো। বয়স্কের এই নির্দেশ মাথা নিচু করে শুনলেও, পুরোটা না মানলেও চলে। তাই নবযুগের চালকের গলায় দেওয়া হল এই যুগান্তরের জোড়া গান। আজও বাঙালি সেই মুগ্ধতার সঙ্গী। সে মুগ্ধতা নতুন মাত্রা পেল, যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথকে ভেবে সলিলবাবু তৈরি করলেন ‘প্রান্তরের গান আমার’। বিশ্বভারতীর তরফে সে গান গাওয়ায় বাধা এল, গাইলেন উৎপলা সেন। বিশ্বভারতীর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ নিয়ে বিপুল শব্দ খরচ হলেও, স্রষ্টার ব্যথিত মনের খোঁজ কে রেখেছে? রবীন্দ্রানুসারী নির্মাণের অন্য গল্পও আছে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিজিৎবাবুর সুরে গেয়েছিলেন ‘তোমার দু’চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় সঞ্চারীতে লিখলেন ‘তোমার দখিন হাতে আমি যে বেঁধেছি রাখি, কাকলিকূজনে তাই মুখর হয়েছে পাখি।’ কবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘তোমার হাতের রাখিখানি বাঁধো আমার দখিন হাতে’, পুলকবাবু গানেই তার উত্তর দিলেন। এ গানে সুর করার কথা বলতে গিয়ে আজও উদাস অভিজিৎবাবুর কণ্ঠ।
পরেশ ধর ছিলেন গণনাট্য সঙ্ঘের সহযোদ্ধা। তাঁর গান ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’ আজও জনপ্রিয়। কিন্তু গণনাট্যের গানগুলির মধ্যেই তাঁকে বেশি করে পাওয়া যাবে, যেমন ‘প্রাণে প্রাণ মিল করে দাও’। এ গান ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার-এর হয়ে আরও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। পরেশবাবু এমনই আদর্শবাদী, যে স্কুলে পড়াতেন সেখানে মতের অমিল হওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলেন। তাঁর গানের মধ্যেও আদর্শের কথা। ‘শান্ত নদীটি’-র শেষ লাইন, ‘ক্রুদ্ধ ঝড়ে উঠবে নড়ে স্তব্ধ প্রকৃতি’। ‘এস মুক্ত করো’-খ্যাত জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রও আদর্শের তুলনায় আত্মপরিচিতিকে পাত্তা দেননি। প্রণব রায়ের ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’— সুধীরলাল চক্রবর্তীর এ গান শুনে চোখ সজল হয়ে ওঠে। সৌভাগ্যের বিষয়, এ গানের কোনও ক্ষয় বা বিকৃতি ঘটেনি। পীতাম্বর দাসের ‘একবার বিদায় দে মা’-র ক্ষেত্রে তা হল না। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র প্রামাণ্য গায়ন অগ্রাহ্য করেই ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ানো হয় ভিন্ন সুর। সে সুর জনপ্রিয়তা পেল সে অন্য কথা, কিন্তু মূলের শুদ্ধতা যে হারিয়ে গেল! সত্তরের দশকে ছায়াছবির গানে নচিকেতা ঘোষের পরে সেরা ছিলেন অজয় দাস। বেসিক গানেও মাতিয়েছেন। শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাটের মোড়ে যে ভিখারি ছেলেটি হাতে পাথর নিয়ে গায়, ‘হয়তো আমাকে কারো মনে নেই, আমি যে ছিলাম এই গ্রামেতেই’, সে জানে, বাসের শ্রোতারা মনে মনেই গাইছেন পরের লাইনগুলি। এ গানের স্থপতি অজয় দাস। গৌরীপ্রসন্ন-অজয় দাস-মান্না দে ত্রয়ী প্রাণবন্ত করেছিলেন ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো’। বনশ্রী সেনগুপ্তর সব অনুষ্ঠানের প্রথম গান ‘দূর আকাশে তোমার সুর’-এ বাঙালিয়ানার মোড়কে পাশ্চাত্য সুরের যে বিস্তৃতি, তার কারিগরও অজয় দাস। এই সুরশিল্পীর প্রাপ্য সম্মানটুকু কেউ বাড়ি বয়ে পৌঁছে দেননি। নচিকেতা ঘোষ আদতে ডাক্তার, কিন্তু ‘বড়’ হয়েছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুরকার হিসেবে। এমনই প্রতাপ ছিল যে, ওঁর ছবির একটি গানে একটা অংশ পছন্দ না হওয়ায় প্রথম অংশ লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয়াংশ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, শুধু এই একটি গানের জন্যই তাঁকে মাথায় করে রাখা যায়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে একমাত্র একটি সিনেমার বই ছাড়া সেই সংবাদ বিস্তারিত ভাবে কোথাও প্রকাশ পায়নি। নচিকেতা ঘোষের ৬৭টি ফিল্মের গান গেয়েছেন মান্না দে, পঞ্চাশটিই অসম্ভব জনপ্রিয়। শোনা যায় উত্তমকুমার নাকি ছবিতে লিপ দেওয়ার সময় নচিকেতা ঘোষকে সামনে বসিয়ে রাখতেন।
কলকাতায় কলুটোলায় থাকাকালীন বড়ে গোলাম আলি খাঁ অর্থসঙ্কটে পড়েছিলেন। এগিয়ে এলেন উৎপলা সেন। সারা দিন ধরে কিছু জোগাড় হল। তত ক্ষণে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় পাহাড়ি ঠুংরি শিখে নিয়েছেন খাঁ সাহেবের কাছ থেকে। সেই সুর বসল অবিস্মরণীয় এক গানে— অনেকেরই জানা নেই, লতা মঙ্গেশকরের প্রথম বাংলা গান ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’-র সুরকার সতীনাথবাবুই। ‘জেগে আছি একা’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘মুক্তির মন্দিরসোপানতলে’ লিখে সাড়া জাগিয়েছিলেন মোহিনী চৌধুরী। উচ্চশিক্ষিত মানুষটি নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপন ছেড়ে, এসেছিলেন গানে। ওঁরই মতো নানা সময়ে শৈলেশ দত্তগুপ্ত, সুবোধ পুরকায়স্থ, পবিত্র মিত্র, অজয় ভট্টাচার্য, অনল চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, রবীন চট্টোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, সুনীলবরণ, অনিল বাগচী, শ্যামল গুপ্ত, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়রা গানের প্রতি শর্তহীন দায়বদ্ধতায় থেকেছেন সতত। বিনিময়ে প্রত্যাশা ছিল না কিছু। পানওনি। ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। শ্রোতামনে ছড়িয়ে পড়েছিল ওঁর সুরের গরিমা— চামেলি, চাঁদ নিয়ে সুরকাব্য তখন শ্রোতার মুখে মুখে। রাহুল দেব বর্মণের কথা যদি বাদও দিই, বাংলা গানের জন্য আলাদা সময় দিয়েছেন রবীন্দ্র জৈন। শিপ্রা বসুর প্রথম দিকের সাড়া জাগানো আধুনিক ‘আমারও বাদল দিন’ অক্ষয় শ্রোতা-মনে।
এমন ‘গল্প হলেও সত্যি’-র শেষ নেই। বড়ে গোলাম আলি খাঁর ঠুংরি শুনতে গিয়েছিলেন সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত ও গায়ক মৃণাল চক্রবর্তী। ঠুংরিতে আচ্ছন্নহৃদয় দু’জন ভোরে হল-এর বাইরে এসে ঠিক করলেন, এই সুর ধরে রেখেই দুটো আধুনিক বাংলা গান তৈরি করা যাক। গান তৈরিও হল তাড়াতাড়ি। মৃণাল চক্রবর্তীর বালিগঞ্জ প্লেস সাউথে বসে শোনা এ গল্প রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল। হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাবু হয়ে বসে শোনাচ্ছেন, ‘কেন জানি না যে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে’। আর সুধীনবাবুর তরফে জবাবি সঙ্গত ছিল, ‘তার চুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে’। দু’টি গান একই রাগের কাঠামোয়, কিন্তু বাক্যবিন্যাসে, অভিঘাতে স্বতন্ত্র। একটি ঠুংরি আধুনিক বাংলা গানের দু’টি কীর্তি গড়ে দিল।
এমন গান তখন তৈরি হয়েছে, আজও যা কান ও প্রাণের আরাম। কারণ, সে গান গেয়েছেন ‘সিদ্ধ’ শিল্পীরা। গানের সে সব কারিগরদের উত্তরপ্রজন্ম সে ভাবে তৈরি হয়নি। এখন অতিমারিতেও উৎসবের মেজাজ, পটুয়াপাড়ায় প্রতিমার পাশে জ্বলজ্বল করছে মৃৎশিল্পীর নাম। বাংলা গানের বাক্ ও সুরপ্রতিমা গড়েছিলেন যে কারিগরেরা, গায়কের সমান নাম বা দাম তাঁরা পাননি। মুছে যাওয়া নামগুলো পিছু ডাকে কি?