গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের মামলায় ট্রায়াল চলছে। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলেই রায় ঘোষণা করবে আদালত। এমতাবস্থায় সিবিআই তদন্ত নিয়েই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নির্যাতিতার পরিবার। তাদের বক্তব্য, অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরাই রয়ে গিয়েছে ওই তদন্তকারী সংস্থার তদন্তে। ওই বিষয়গুলি আবার তদন্তের আওতায় নিয়ে আসুক সিবিআই। এই মর্মে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। তাঁদের তরফে কী কী প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে? কেন আবার তদন্তের দাবি করছেন তাঁরা?
গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিকেল কলেজের মহিলা চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণ হন। ওই ঘটনার পরে পরিবারের কাছে তাঁদের মেয়ে অসুস্থ বলে প্রথমে ফোন যায়। পরে পরিবারকে বলা হয়, তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করছে। হাই কোর্টে মামলা করে নির্যাতিতার বাবার বক্তব্য, ওই দিন ফোন করেছিলেন হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারটেনডেন্ট। ওই তদন্তে তাঁকে জেরাই করেনি সিবিআই। গত ৯ অগস্ট সকাল ১০:৪৫ মিনিটে তিনি কার নির্দেশে ফোন করেছিলেন? ওই সময় তাঁর পাশে কে ছিলেন? ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রথমে অসুস্থ এবং পরে আত্মহত্যা কেন বলেছিলেন? কে এমন বলতে বলেছিলেন? তদন্তে সেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।
নির্যাতিতার ময়নাতদন্ত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে পরিবারের। বাবার দাবি, মেয়ের দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্তের দাবি গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। প্রথম বারের ময়নাতদন্ত নিয়ে সন্দেহের জায়গা রয়েছে। হাই কোর্টে মামলায় তাঁর বক্তব্য, ময়নাতদন্তের জন্য চিকিৎসকদের একটি দল গঠন করা হয়। ওই দলে ছিলেন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মল্লি বন্দ্যোপাধ্যায়। আরজি কর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সারা রাজ্যের মধ্যে অন্যতম বিশেষজ্ঞ। তিনি থাকতে অন্য হাসপাতাল থেকে কেন ফরেনসিক ডাকা হল? মল্লির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিবার। মামলায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন মল্লি। তাঁর থেকে যোগ্য এবং অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়া হল না কেন?
সময়ে চার্জশিট জমা দিতে না পারায় আরজি কর মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে জামিন দিয়েছে আদালত। ওই ঘটনায় সন্দীপের ভূমিকাকে লঘু করে দেখেছে সিবিআই। হাই কোর্টে বাবার আবেদন, সিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হোক সন্দীপ কেন থানায় এফআইআর করলেন না তা খুঁজে বার করার। তদন্ত করে দেখা হোক তাঁর পরিচিত রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের সদস্য অভীক দে এবং বিরূপাক্ষ বিশ্বাস কেন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। সন্দীপের টাওয়ার লোকেশন অনুযায়ী ওই দিন তিনি কোথায় ছিলেন, কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন? সিবিআই তদন্তে সেই সব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায়নি।
ওই ঘটনায় আরও অনেকের বয়ান নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছে নির্যাতিতার পরিবার। ঘটনার দিন রাতে কর্তব্যরত সবার বয়ান নেওয়া হয়নি বলে তাদের দাবি। পরিবারের আর্জি, গত ৮ অগস্ট রাতে ওই বিভাগের কোন কোন চিকিৎসক কর্তব্যরত ছিলেন তাঁদের সবার বয়ান নেওয়া হোক। পরিবারের প্রশ্ন, ওই দিন রাত ১১টার পরের সম্পূর্ণ সিসিটিভি ফুটেজ কেন সিবিআইকে দেওয়া হল না? সিবিআইয়ের ‘ত্রুটি’র অভিযোগ তুলে পরিবারের বক্তব্য, ঘটনাস্থলে বিছানার চাদর, নির্যাতিতার জুতো, খোলা অবস্থায় ল্যাপটপ, জলের বোতল একই অবস্থানে ছিল। যেখানে বাঁচা-মরার লড়াই সেখানে দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হলে সেগুলির উপর তার কোনও প্রভাব কেন পড়ল না? এমনকি ঘটনাস্থলেও বিশৃঙ্খলার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রমাণ লোপাটের আশঙ্কাও অমূলক নয়।
এ ছাড়া পরিবারের আরও প্রশ্ন, হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে কেন নির্যাতিতার বাবা-মাকে মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি? তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কেন সন্দীপ তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চাননি? মৃতদেহ সরাসরি পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে কেন স্থানীয় বিধায়ক এবং কাউন্সিলরের নজরদারিতে তড়িঘড়ি সৎকার করা হল? এত বড় ঘটনার পরেও কার নির্দেশে অকুস্থলের পাশের অংশে ভাঙার কাজ চলতে থাকে? সিবিআই তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে নির্যাতিতার বাবা-মা বলছেন, এত প্রশ্নের উত্তর ছাড়া কী ভাবে তদন্ত সম্পূর্ণ হতে পারে? ফলে হাই কোর্ট পুরো বিষয়টি আবার সিবিআইকে তদন্ত করে দেখতে বলুক। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ মামলা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার এই মামলার শুনানি। ওই দিন মামলা সংক্রান্ত নথি সিবিআইকে নিয়ে যেতে বলেছে হাই কোর্ট।