China Taiwan Crisis

সমুদ্রের ঘোলা জলে ডোবার ভয়ে জুজু! মলাক্কা কাঁটার খোঁচা সয়ে তাইওয়ান নিয়ে মুখেই গর্জন জিনপিংয়ের

বর্ষশেষে ফের চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের গলায় শোনা গেল তাইওয়ান দখলের হুঙ্কার। মলাক্কা প্রণালীর চক্রব্যূহে আটকে পড়ার ভয়েই কি গর্জালেও বর্ষণে নেই বেজিং?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:২৮
Share:
০১ ১৮

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট একটা দ্বীপরাষ্ট্র। ‘শকুন-দৃষ্টি’তে সে দিকে চেয়ে আছে ড্রাগনের লালফৌজ! কী ভাবে গোটা দ্বীপটাকে কব্জা করবে, রাত-দিন মাথায় ঘুরছে তারই মতলব। অষ্টপ্রহর তাঁদের শাসানি আর হুমকিতে ঘুম উড়েছে ওই দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের।

০২ ১৮

মহাসমুদ্রের বুকের সাবেক ‘ফরমোজ়া’ দ্বীপকে আজ গোটা দুনিয়া চেনে তাইওয়ান নামে। দীর্ঘ দিন ধরেই যাকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে বেজিং। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দা সূত্রে খবর, তাইওয়ান দখলের নীল নকশাও ছকে ফেলেছেন চিনা চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বাদ সাধছে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার একটা ‘সরু গলি’র অনন্ত জলরাশি। ড্রাগনের প্রাণভোমরাও সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement
০৩ ১৮

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরের ওই এলাকার পোশাকি নাম মলাক্কা প্রণালী। বিশ্লেষকদের দাবি, তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট শি-র সামরিক অভিযানের ‘পথের কাঁটা’ হতে পারে এই সামুদ্রিক রাস্তা। কৌশলগত কারণে এর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল বেজিং। যুদ্ধের সময়ে এই প্রণালী বন্ধ হলে আর্থিক রক্তক্ষরণের জেরে চিনের যে প্রবল ছটফটানি শুরু হবে, তা বলাই বাহুল্য।

০৪ ১৮

মলাক্কা প্রণালী ভারত মহাসাগরকে দক্ষিণ চিন সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। চিনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এই জলপথের উপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি, এই রাস্তা দিয়েই ৮০ শতাংশ কাঁচা তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে বেজিং।

০৫ ১৮

চায়না অ্যারোস্পেস স্টাডিজ ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ড্রাগনল্যান্ডের প্রাথমিক সামুদ্রিক পরিবহণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হল মলাক্কা প্রণালী। ইন্দোনেশিয়ার গা ঘেঁষে এই রাস্তা দিয়েই বেজিংয়ের মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চিন সাগর, ভারত মহাসাগর এবং লোহিত সাগরে পাড়ি দেয়। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকার নৌসেনা এই পথ বন্ধ করতে পারলে আর্থিক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে পড়বে জিনপিংয়ের দেশ।

০৬ ১৮

তাইওয়ান দখলের স্বপ্নে বিভোর চিন গত কয়েক বছরে মলাক্কা প্রণালীর উপরের নির্ভরতা কমানোর কম চেষ্টা করেনি। জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির দিকে নজর দিয়েছে বেজিং। কিন্তু, তাতে ড্রাগনের শক্তির চাহিদা মিটেছে এমনটা নয়। উল্টে শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ঠিক রাখতে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর তাই ‘তরল সোনা’ বা প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বন্ধ করা বা কমানোর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে শি প্রশাসন।

০৭ ১৮

এই অবস্থায় ‘দাদাগিরি’র রাস্তা ধরেছে ড্রাগন। দক্ষিণ চিন সাগর এবং ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজেদের মালবাহী জাহাজগুলিকে সুরক্ষিত করার নামে সুবিশাল নৌবহর তৈরি করেছে চিনের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ)। আকারের নিরিখে আমেরিকার নৌবাহিনীর থেকেও এটি বড়। কিন্তু তার পরেও এই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জলযোদ্ধাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বেজিংকে।

০৮ ১৮

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা হোক বা আটলান্টিক— দুনিয়া জুড়ে আমেরিকান নৌবাহিনীর আধিপত্য খতম করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে পিএলএ। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া এবং আফ্রিকার দেশ জিবুতির নৌছাউনি। কিন্তু, তাতেও ওয়াশিংটনের প্রভাব যে ড্রাগন সেনা কমাতে পেরেছে, এমনটা নয়।

০৯ ১৮

সাম্প্রতিক সময়ে মলাক্কা প্রণালী সংলগ্ন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপিন্সের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদে জড়িয়েছে চিন। ফলে খুব সহজেই এই সব দেশের সমর্থন পেয়ে গিয়েছে আমেরিকা। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এটি বেজিংয়ের চিন্তা বাড়িয়েছে। এই দেশগুলি এক দিকে যেমন নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে শুরু করেছে, অন্য দিকে তেমনই সেনাঘাঁটি তৈরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।

১০ ১৮

এ ছাড়া মলাক্কা প্রণালী এড়ানোর আরও একটি পন্থা নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। সেটি হল তাঁর স্বপ্নের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’। এতে মোট তিনটি প্রকল্প রয়েছে। সেগুলি হল, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপিইসি), চিন মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডর (চায়না মায়ানমার ইকোনমিক করিডর বা সিএমইসি) এবং রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে প্রস্তাবিত দু’নম্বর পাইপলাইন। তিনটি ক্ষেত্রেই নানা সমস্যা বিভিন্ন ভাবে ঘিরে রেখেছে বেজিংকে।

১১ ১৮

২০১৩ সালে সিপিইসির কাজ শুরু করে ড্রাগন। এর জন্য মোট ৬,২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে শি সরকার। কিন্তু পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দারা এই প্রকল্পের প্রবল বিরোধী। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার বালুচ বিদ্রোহীদের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন এতে কর্মরত চিনা ইঞ্জিনিয়াররা। ফলে গতি হারিয়েছে এর কাজ। কিছু কিছু জায়গায় এটি সম্পূর্ণ ভাবে থমকে রয়েছে।

১২ ১৮

একই কথা সিএমইসির ক্ষেত্রেও সত্যি। লম্বা সময় ধরে মায়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ। সম্প্রতি সামরিক জুন্টা সরকারের হাতছাড়া হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গা। সেখানে একরকম স্বায়ত্তশাসন চালাচ্ছে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সিপিইসির রাস্তায় পশ্চিম এশিয়ার থেকে তেল এবং গ্যাস আমদানির স্বপ্ন দেখেছিল চিন। দ্বিতীয়ত, এই দু’টি আর্থিক করিডরের কাজ শেষ করতে পারলে মলাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে পিএলএর জন্য খুলে যেত আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের দরজা।

১৩ ১৮

অন্য দিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবেরিয়া দু’নম্বর পাইপলাইন তৈরির কাজে হাত দিতে চাইছে চিন। কিন্তু সেখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা মঙ্গোলিয়া। সাইবেরিয়ার ওই পাইপলাইন চেঙ্গিস খানের জন্মভিটার উপর দিয়ে আসার কথা রয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক ভাল না হওয়ার দরুন বেজিংয়ের ইচ্ছায় জল ঢালতে পারে মঙ্গোলিয়ার সরকার।

১৪ ১৮

এ ছাড়া রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক শহরের উপরেও নিজেদের অধিকার কায়েম করতে চাইছে চিন। ওই এলাকার নতুন নামকরণও করেছেন ড্রাগন চেয়ারম্যান জিনপিং। ফলে ক্ষুব্ধ মস্কো প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছে না। এই পাইপলাইনের কাজ শেষ হলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে কোনও চিন্তাই থাকত না বেজিংয়ের।

১৫ ১৮

এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাওয়ানের চিনে সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটছেন না চেয়ারম্যান শি। ৩১ ডিসেম্বর নতুন বছরের ভাষণে ফের এক বার সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। জিনপিং বলেছেন, ‘‘তাইওয়ান প্রণালীর দু’পারের চিনা নাগরিকেরা একই পরিবারের অংশ। কেউ আমাদের রক্তের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না। মাতৃভূমির পুনর্মিলনের ঐতিহাসিক ধারাও কারও পক্ষে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়।’’

১৬ ১৮

নতুন বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কুর্সিতে বসার তিন সপ্তাহ আগে চিনা প্রেসিডেন্টের এ হেন হুঁশিয়ারি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য তাইওয়ানের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চিন শেষ পর্যন্ত সেনা অভিযান শুরু করলে ওয়াশিংটন সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মহল।

১৭ ১৮

২০২২ সালের চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম পার্টি কংগ্রেসে লালফৌজের আধুনিকীকরণে জোর দেন প্রেসিডেন্ট শি। ২০২৭ সালে ১০০ বছরে পা দেবে পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি। এই সময়সীমার মধ্যে স্থল, জল, আকাশ এবং অন্তরীক্ষ সব দিক থেকে বাহিনীকে আমেরিকার সমকক্ষ করে তুলতে চাইছে বেজিং।

১৮ ১৮

আমেরিকার গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ২০২৭ বা ২০৩৫ সাল নাগাদ তাইওয়ান আক্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে প্রেসিডেন্ট শির। সেই লক্ষ্যে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন তিনি। ২০২৪ সালে মোট তিন বার তাইওয়ানকে ঘিরে বড় সামরিক মহড়া চালিয়েছে পিএলএর নৌসেনা। পাশাপাশি সেখানকার নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে মান্যতাই দেয়নি বেজিং।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement