অতি শক্তিশালী অদৃশ্য রশ্মির কামাল। এর এক আঘাতে চূর্ণ হবে আস্ত একটা গ্রহ! সেই হাতিয়ার নির্মাণকে কেন্দ্র করে এক সময়ে আটলান্টিকের পারে চলে জোর চর্চা। অবিলম্বে অস্ত্রটি তৈরির পক্ষে সুর চড়িয়েছিলেন নাগরিকদের একাংশ। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে সরকারের উপর চাপও তৈরি করেন তাঁরা। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে মুখ খোলে প্রশাসনও।
২১ শতকে পা দেওয়া ইস্তক সরাসরি শক্তি প্রয়োগকারী হাতিয়ারের (ডিরেক্ট এনার্জি ওয়েপন) গবেষণায় গতি এনেছে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ। এর মধ্যে অন্যতম হল লেজ়ার অস্ত্র। ইতিমধ্যেই রণক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রয়োগ করেছে ইজ়রায়েল। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) হিসাবে ‘আয়রন বিম’ নামের একটি হাতিয়ার তৈরি করেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা।
লেজ়ারকে একরকমের অদৃশ্য অস্ত্র বলা যেতে পারে। এর শক্তি অপরিসীম। দ্বিতীয়ত, এক বার তৈরি হয়ে গেলে খরচের দিক থেকে লেজ়ার হাতিয়ার অত্যন্ত সাশ্রয়ী। যদিও এর নির্মাণের খরচ যথেষ্ট বেশি। ইজ়রায়েল ‘আয়রন বিম’ তৈরি করার পর ফের এক বার আলোচনায় চলে এসেছে আমেরিকার লেজ়ার অস্ত্র এবং মহাশূন্য তারা-যুদ্ধের প্রসঙ্গ।
প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি, লেজ়ার হাতিয়ার এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে, তার প্রয়োগে আস্ত একটা গ্রহকেও উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরই যুক্তরাষ্ট্র জু়ড়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। এই অস্ত্র তৈরির পক্ষে রায় দেন বহু আমেরিকাবাসী। ২০১৬ সালের মধ্যে হাতিয়ারটি নির্মাণ করার লক্ষ্যমাত্রা সরকারের সামনে রাখেন তাঁরা।
২০১৩ সালে এই সংক্রান্ত একটি আবেদনপত্র জমা পড়ে ওয়াশিংটনের সাদা বাড়িতে (হোয়াইট হাউস)। তাতে সই ছিল ৩৪ হাজার আমেরিকাবাসীর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে তখন বারাক হুসেন ওবামা। এই ইস্যুতে আমজনতার সন্দেহ দূর করতে জবাব দেয় তাঁর প্রশাসন।
আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী, ২৫ হাজার বা তার বেশি সই সম্বলিত কোনও আবেদনপত্র সরকারের ঘরে জমা পড়লে সরকার উত্তর দিতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে খাটবে না গোপনীয়তার অধিকার। ওবামা প্রশাসন স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এই রকম কোনও হাতিয়ার তৈরি করা হচ্ছে না। এর পিছনে দ্বিমুখী যুক্তি সাজিয়েছিল ওয়াশিংটন।
আমেরিকার তৎকালীন বিজ্ঞান এবং মহাকাশ প্রশাসনের বাজেট অফিসার পল স্ক্রুজ বলেন, ‘‘ডেথ স্টারের (নক্ষত্র বা গ্রহের মৃত্যু) মতো ধ্বংসাত্মক প্রকল্পকে উৎসাহ দেওয়া অর্থহীন। আমাদের মহাকাশ গবেষণা শুধুমাত্র মানবকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্তরীক্ষে তারা-যুদ্ধে কখনওই নামবে না আমেরিকা।’’
যদিও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই ধরনের লেজ়ার হাতিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার মূল কারণ অর্থনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, অস্ত্রটি তৈরি করতে ন্যূনতম খরচ হবে সাড়ে আট লক্ষ কোটি ডলার। একটি হাতিয়ারের জন্য এত টাকা ব্যয় করা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন তিনি।
লেজ়ারের এ-হেন ‘সুপার ওয়েপন’-এর প্রথম উল্লেখ অবশ্য পাওয়া গিয়েছে কল্পবিজ্ঞানে। বিশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নে এটিকে হাতিয়ারে বদলে ফেলার চেষ্টা চালান রুশ প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। তবে তাঁরা যে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিলেন, এমনটা নয়।
পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে ‘লেজ়ার ফিউশন’ নামের গবেষণাধর্মী একটি প্রকল্পের সূচনা করে আমেরিকার সরকার। অন্য দিকে একই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা। দু’টি ক্ষেত্রেই লেজ়ারের শক্তি জানতে হিরেকে বেছে নেন গবেষকদের দল। আর সেখানেই আসে সাফল্য।
পরীক্ষার সময়ে একটি স্ফটিক স্বচ্ছ হিরের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন কৌণিক বিন্দু থেকে বিজ্ঞানীরা পাঠিয়ে দেন একাধিক লেজ়ার রশ্মি। এর পর দেখা যায় প্রতিটা আলাদা আলাদা লেজ়ার বিম জুড়ে গিয়ে একটি রশ্মিতে পরিণত হচ্ছে। এতে উচ্চ শক্তি নির্গত করছে ওই লেজ়ার রশ্মি।
হিরের উচ্চ তাপ সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে। ফলে এতে সে ভাবে সক্রিয়তা পায়নি লেজ়ার রশ্মি। কিন্তু ওই পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা বুঝে যান যে একত্রিত অবস্থায় লেজ়ার বিম ব্যবহার করা মোটেই কঠিন নয়। আর এতে অপার শক্তি লাভের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ম্যাককুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক রিচ মিলড্রেন বলেছেন, ‘‘লেজ়ার উপাদানগুলির ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েছে। এগুলি বর্জ্য তাপের লোডকে অপসারণ করতে চায়। অত্যধিক তাপের কারণে লেজ়ার রশ্মি জ্বলে উঠতে পারে। তখন কমবে এর শক্তি। সে ক্ষেত্রে সঠিক নিশানায় কোনও কিছুকে ধ্বংস করা বেশ কঠিন হতে পারে।’’
হিরেতে লেজ়ারের শক্তি পরীক্ষা সফল হওয়ার পর থেকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন হাতিয়ার তৈরির দিকে নজর দেন বিজ্ঞানীরা। মিলড্রেন জানিয়েছেন, ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো শত্রুর অস্ত্রকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে লেজ়ার অত্যন্ত উপযোগী হতে পারে। যদিও এর সঠিক প্রয়োগ কোনও সেনাবাহিনীই করে উঠতে পারেনি।
বিজ্ঞানীদের দাবি, মহাশূন্যের আবর্জনা সরাতে উচ্চ শক্তির লেজ়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট আকারের উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর দিকে এগিয়ে এলে সেগুলির উপরেও লেজ়ারের প্রয়োগে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে একটি গ্রহকে ধ্বংস করার মতো লেজ়ার শক্তি খাতায়কলমে বলা গেলেও তা বাস্তবে তৈরি করা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহের কথা জানিয়েছেন তাঁরা।
২০২৪ সালের ৩০ মার্চ ‘লেজ়ার অ্যান্ড ফোটোনিক্স রিভিউ জার্নাল’-এর অনলাইন প্রতিবেদনে লেজ়ারের শক্তি এবং ফৌজি ক্ষেত্রে তার ব্যবহার সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, বর্তমানে লেজ়ার অস্ত্র তৈরির দিকে নতুন করে নজর দিয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং ফ্রান্স।
সরাসরি শক্তির অস্ত্র বলতে অবশ্য শুধু লেজ়ারকে গণ্য করলে তা ভুল হবে। অন্য কিছু শক্তিকেও এই কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। সূত্রের খবর, লেজ়ার প্রযুক্তি নিয়ে অতি গোপনে কাজ চালাচ্ছে ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। তবে এই নিয়ে এখনও সরকারি স্তরে কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি।