‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর শিং ধরে টানাটানি! দুই খ্যাপা ষাঁড়ের মাঝে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ ঘটল তৃতীয় ব্যক্তির। নিপুণ কায়দায় তাদের শান্ত করে যে তিনি এলাকা ছাড়লেন, তা নয়। দু’জনের মধ্যে হওয়া চুক্তির খসড়াটাও এল তাঁরই হাত ঘুরে। অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের তীর ঘেঁষা গন্ডারের শিংয়ের মতো দেখতে আফ্রিকা মহাদেশের সরু একফালি জায়গা। পোশাকি নাম ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’। সেখানকার দু’টি দেশ ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যে বিবাদ দীর্ঘ দিনের। নতুন বছরের শুরুতেই ঝগড়া ভুলে কাছাকাছি এল এই দুই রাষ্ট্র। বন্ধুত্বের এই নয়া ইতিহাস লিখতে সাহায্য করেছে ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় তাঁর এই সাফল্য চিন্তা বাড়িয়েছে আমেরিকার।
আফগানিস্তান বা নেপালের মতো ইথিওপিয়া পুরোপুরি জমি দিয়ে ঘেরা একটি দেশ। সমুদ্র উপকূল না থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করা তার পক্ষে একরকম অসম্ভব। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে আফ্রিকার এই রাষ্ট্রটি উপকূলের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। এই ইস্যুতেই প্রতিবেশী সোমালিয়ার সঙ্গে বিবাদ চরমে ওঠে তার।
১৯৯৩ সালে ইথিওপিয়ার থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ইরিত্রিয়া। ফলে কৌশলগত দিক থেকে আরও সমস্যায় পড়ে পূর্ব আফ্রিকার ওই রাষ্ট্র। এত দিন ইরিত্রিয়ার উপকূল দিয়ে লোহিত সাগর ব্যবহার করছিল আদ্দিস আবাবার সরকার। সেই রাস্তা বন্ধ হওয়ায় একরকম আতান্তরে পড়ে তারা।
পরবর্তী দশকগুলিতে প্রতিবেশী দেশ জিবুতির উপর আর্থিক দিক থেকে অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ইথিওপিয়া। জিবুতির উপকূল ব্যবহার করেই চলছিল আদ্দিস আবাবার সিংহভাগ বাণিজ্য। কিন্তু এর খরচ দিন দিন বাড়তে থাকায় বিপাকে পড়ে পূর্ব আফ্রিকার ওই দেশ। ফলে আর এক প্রতিবেশী দেশ সোমালিয়ার দিকে নজর ঘোরায় তারা।
২০০৪ সালে সোমালিল্যান্ডের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ইথিওপিয়া। চুক্তিটি পূর্ব আফ্রিকার দেশটির কাছে লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের রাস্তা খুলে দেয়। ফলে একে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসাবেই দেখেছিলেন ইথিওপিয়ার শাসকেরা। কিন্তু এই চুক্তিকে কেন্দ্র করেই সোমালিয়ার সঙ্গে তলানিতে গিয়ে ঠেকে সম্পর্ক।
সোমালিয়ার উত্তর দিকের একটি অংশ সোমালিল্যান্ড হিসাবে পরিচিত। এই এলাকার শাসনব্যবস্থা চালায় সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক বছর ধরেই আলাদা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চেয়ে আসছে সোমালিল্যান্ড। আন্তর্জাতিক স্তরে এখনও পর্যন্ত অবশ্য সেটা মেলেনি। অন্য দিকে মোগাদিশু সোমালিল্যান্ডকে সোমালিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে।
এই অবস্থায় সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে আলাদা করে ইথিওপিয়ার চুক্তি সোমালিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। একে সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার পথে বড় আঘাত বলে মনে করেছিল মোগাদিশু। ফলে দ্রুত ওই চুক্তি বাতিল করতে হুঁশিয়ারি দেয় পূর্ব আফ্রিকার ‘জলদস্যুদের দেশ’।
সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে হওয়া চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় ইথিওপিয়া। এতে ‘আফ্রিকার শিং’-এ (হর্ন অফ আফ্রিকা) ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ওই সময়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেয় মোগাদিশু। পাশাপাশি ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে চলতে থাকে আক্রমণাত্মক কূটনৈতিক অভিযান।
এই অবস্থায় দ্বন্দ্ব থামাতে বড় ভূমিকা নেয় তুরস্ক। সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়াকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে আঙ্কারা। ইউরোপের এই ‘রুগ্ন মানুষ’টির মধ্যস্থতায় যুদ্ধের রাস্তা থেকে সরে আসে পূর্ব আফ্রিকার এই দুই দেশ। শেষ পর্যন্ত ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর শিংয়ে লড়াই বাধলে সেখানকার বাণিজ্যিক রাস্তা অস্থির করে তুলত। লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর পর্যন্ত এটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
সূত্রের খবর, ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যে হওয়া নতুন চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হবে বলে জানা গিয়েছে। মোট তিন দফা আলোচনার পর একে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছে দুই দেশের সরকার। উল্লেখ্য, তিন দফা আলোচনায় হাজির ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এর্দোগান।
পূর্ব আফ্রিকার দুই দেশের এ হেন বন্ধুত্বকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের কথায়, এতে লাভ হয়েছে দু’পক্ষেরই। ইথিওপিয়ায় জাতিগত সমস্যা রয়েছে। আদ্দিস আবাবার আর্থিক সঙ্কটও কম নয়। সেখানকার স্থানীয় মুদ্রার দ্রুত অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এই অবস্থায় যুদ্ধের অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করা তাদের পক্ষে বেশ কঠিন হত।
অন্য দিকে ইথিওপিয়ার সঙ্গে সংঘাত মিটে যাওয়ায় ঐক্যবদ্ধ সোমালিয়া গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে পারবে মোগাদিশু। সোমালিল্যান্ডের থেকে স্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করাই এখন তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে আল-শাবাব নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী যথেষ্ট সক্রিয়। তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা মোগাদিশুর পক্ষে অনেক বেশি সহজ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
তবে এই চুক্তিকে মোটেই ভাল ভাবে দেখছে না মিশর। লম্বা সময় ধরে ইথিওপিয়াকে এক ঘরে করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে কায়রো। কিন্তু সোমালিয়ার সঙ্গে আদ্দিস আবাবার বন্ধুত্বে সেটা যে অনেকাংশই ধাক্কা খেল তা বলাই বাহুল্য। নীলনদের উপর বর্তমানে চলছে গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধের কাজ। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এটি ভবিয্যতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলেই মনে করে ‘পিরামিড রাষ্ট্র’।
অন্য দিকে এই চুক্তির জেরে আফ্রিকায় বড় খেলোয়াড় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল তুরস্ক। মোগাদিশুর একাধিক সেনা ছাউনির পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করছে আঙ্কারা। ভবিষ্যতে ‘আফ্রিকার শিং’-এ নৌসেনা ঘাঁটি তৈরির অনুমতি পেতে পারে ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’। তাঁর সামনে খুলতে পারে ‘অন্ধকার মহাদেশে’ হাতিয়ার বিক্রির বাজারের দরজা।
পাশাপাশি, এই চুক্তিকে সোমালিল্যান্ডের আলাদা করে রাষ্ট্রের মর্যাদার পাওয়ার রাস্তায় বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে। সোমালিয়া ভেঙে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল আমেরিকাও। ওয়াশিংটনের সেই পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
‘হর্ন অফ আফ্রিকা’র কৌশলগত অবস্থানকে মাথায় রেখে গত কয়েক বছরে একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের ওই এলাকার দিকে নজর পড়েছে। তালিকায় রয়েছে চিন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। সেখানে সবাইকে দাবার চালে মাত করে আলাদা ভাবে আত্মপ্রকাশ করল তুরস্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার বন্ধুত্বের বিষয়টি জটিল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে নেটো শক্তিজোটে থাকা তুরস্কের উপর ওয়াশিংটনের বেজায় খাপ্পা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে আবার চিন ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’য় পা জমাতে না পারায় খুশি হতে পারেন আমেরিকার সেনাকর্তারা। তবে এই ‘দস্তি’র কতটা প্রভাব বিশ্ব রাজনীতির উপর পড়বে, তার উত্তর দেবে সময়।