ভারতীয় নৌসেনার আট প্রাক্তন আধিকারিকের মৃত্যুদণ্ডের সাজা রদ করেছে কাতার। বৃহস্পতিবার বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, তাদের আবেদন মেনে কাতারের একটি আদালত ওই আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা মকুব করেছে।
তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রতিলিপি এখনও পর্যন্ত পাওয়া না-যাওয়ায় নৌসেনার আট জন আধিকারিক কী শাস্তি পেতে চলেছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কাতারের আইন-আদালত সম্পর্কে অভিজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ওই আট জনের যাবজ্জীবন কয়েদবাসের সাজা হতে পারে।
নৌসেনার আট সেনা আধিকারিকের মৃত্যুদণ্ডের সাজা রদ করার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে অনেকেই ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যকে দেখছেন। ভারত কী ভাবে এই কূটনৈতিক চালে কিস্তিমাত করল, তা নিয়েও চর্চা চলছে।
গত ২৬ অক্টোবর কাতারের একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত ওই আট জনকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় কাতারের একটি আদালত। জানা যায় যে, দুর্নীতি এবং ইজ়রায়েলের হয়ে চরবৃত্তির অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে তাঁদের।
যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ, তা ভারত কিংবা কাতার — দুই তরফেই সরকারি ভাবে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তবে যা জানা গিয়েছিল, তা হল ‘আল-দাহরা গ্লোবাল টেকনোলজি’ নামের একটি পরামর্শদাতা সংস্থায় কাজ করতেন নৌসেনার ওই প্রাক্তন আট আধিকারিক।
এই সংস্থার মালিক তথা ওমানের বায়ুসেনার প্রাক্তন আধিকারিক খামিস আল আজামিকে আগেই গ্রেফতার করেছিল কাতার প্রশাসন। যদিও ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই একই মামলায় চলতি বছরের অগস্ট মাসে আটক করা হয় ভারতীয় নৌসেনার আট প্রাক্তন আধিকারিককে।
নৌসেনার একটি সূত্র মারফত জানা যায়, ওই আট জন নিজেদের কর্মজীবনে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে কাতারের ওই বেসরকারি সংস্থায় যোগ দেন। সংস্থাটি মূলত কাতারের নৌবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করত বলে ওই সূত্র মারফত জানা গিয়েছে।
আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা হওয়ার পরেই ভারত সরকার সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, গোটা ঘটনাটি ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’। একই সঙ্গে নয়াদিল্লি জানিয়েছিল যে, এই মামলায় তারা সম্ভাব্য সমস্ত আইনি দিক খতিয়ে দেখছে।
আট জনের পরিবারের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছিল ভারত। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরিবারগুলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। গত ১ ডিসেম্বর দুবাইয়ে হওয়া জলবায়ু সংক্রান্ত সম্মেলন ‘কপ২৮’-এ যোগ দিতে গিয়ে কাতারের আমির হামাদ আল থানির সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সেই বৈঠকের নির্যাস হিসাবে ভারত জানিয়েছিল যে, কাতারে বসবাসকারী ভারতীয়দের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কথা হয়েছে। তবে একটি সূত্র মারফত এ-ও জানা গিয়েছিল যে, বৈঠকে আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাস করার বিষয়টিও তোলে ভারত।
মোদীর সঙ্গে কাতারের আমির বৈঠক করার ঠিক দু’দিন পরেই কাতারে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ওই প্রাক্তন আট আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করার কূটনৈতিক ছাড়পত্র দেয় কাতার। তার ২৫ দিন পর কাতারের উচ্চতর আপিল আদালত তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিল।
প্রশ্ন হল, ওই আট জনের ভাগ্য এখন কোন পথ ধরে এগোবে? এ ক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। এক, কাতারের কোনও জেলেই বাকি জীবন কাটাতে হতে পারে তাঁদের।
দুই, কাতারের আমির ‘মানবিকতার খাতিরে’ তাঁদের মুক্তি দিতে পারেন। আর তিন, ভারতে ওই আট জনকে ফিরিয়ে আনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভারতের কোনও জেলেই কয়েদবাসের গোটা পর্ব কাটাতে হতে পারে তাঁদের।
২০১৫ সালে কাতারের আমির ভারত সফরে আসার পর দুই দেশের মধ্যে একাধিক সমঝোতাপত্র (মউ) স্বাক্ষরিত হয়। সেগুলির একটি ছিল দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে বন্দি বিনিময় করবে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের কাছাকাছি থেকে কয়েদবাসের মেয়াদ পূরণ করার সুযোগ পাবেন বন্দিরা।
কাতারের নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আগেই ভারত উচ্চতর আপিল আদালতে আবেদন জানিয়েছিল। চলতি মাসে কাতারের সংশ্লিষ্ট আদালত ভারতের আবেদন গ্রহণ করে। ভারত আপাতত পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য প্রতীক্ষা করছে। তার পর তাঁদের সাজা মকুবের জন্য উচ্চতম আদালতে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
কাতারে মৃত্যুদণ্ডের সাজামুক্ত প্রাক্তন নৌসেনা কর্তারা হলেন, ক্যাপ্টেন নবতেজ সিংহ গিল, ক্যাপ্টেন বীরেন্দ্রকুমার বর্মা, ক্যাপ্টেন সৌরভ বশিষ্ঠ, কমান্ডার অমিত নাগপাল, কমান্ডার পূর্ণেন্দু তিওয়ারি, কমান্ডার সুগুণাকর পাকালা, কমান্ডার সঞ্জীব গুপ্তা এবং নাবিক রাজেশ।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর কাতারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে ভারত। ১৯৭৩ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে নয়াদিল্লি। সম্প্রতি এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপন করে দুই দেশ।