অপেক্ষার অবসান। দিয়েগো মারাদোনা থেকে লিয়োনেল মেসি— আর্জেন্টিনা ফুটবলের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে রবিবার। কাতারের লুসেইল স্টেডিয়াম সাক্ষী থেকেছে সেই ইতিহাসের।
৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। ফ্রান্সের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে ‘সর্বকালের সেরা’ মেসি বিশ্বকাপের গায়ে এঁকে দিয়েছেন বহু প্রতীক্ষিত চুম্বন।
কাতার বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দুরন্ত ফর্মে ছিলেন মেসি। শেষ বিশ্বকাপে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়েছেন। আর্জেন্টিনার প্রতিটি জয়ের শেষে এলএম১০-এর উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।
চলতি বিশ্বকাপে মেসি বা তাঁর সতীর্থদের উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভঙ্গিতে কিছু বিশেষত্ব ছিল। যা অনুরাগীদের চোখ এড়ায়নি। প্রায় প্রত্যেক ম্যাচের শেষে বা কোনও গোল হওয়ার পর দেখা গিয়েছে সেই উচ্ছ্বাস।
দু’হাত উপরে তুলে গ্যালারিতে বসে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উদ্দেশে বার বার নির্দিষ্ট ছন্দে হাত নেড়েছেন মেসি। তালে তালে দুলেছে তাঁর শরীরও।
হাত নেড়ে কী বলার চেষ্টা করছিলেন মেসি? তালে তালে হাতের ওঠানামায় কিসের ইঙ্গিত ছিল?
অভিনব এই উচ্ছ্বাসের গূঢ় অর্থ বেশি দিন গোপন থাকেনি। জানা গিয়েছে, বিশ্বকাপের মঞ্চে আসলে একটি বিশেষ গানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন মেসিরা। তারই তালে তালে আনন্দে লাফাচ্ছিলেন, নাচিয়ে তুলছিলেন সমগ্র আর্জেন্টিনাকে।
গানটির নাম ‘মুচাচোস’। স্প্যানিশ ভাষায় এই শব্দের অর্থ ‘তারুণ্য’। এই গানই বিশ্বকাপে তাতিয়েছে মেসিদের। কাতারের গ্যালারিতে কিংবা আর্জেন্টিনার রাস্তায় রাস্তায় এই গানের সুর ধ্বনিত হয়েছে গত কয়েক দিন ধরে। গানে গানেই জয়ের উদ্যাপন করেছেন এলএম১০।
বিশ্বকাপ মাতিয়ে দেওয়া এই গান লিখেছেন কোনও এক আর্জেন্টিনীয় সমর্থক। তাঁকে কুর্নিশ করেছেন স্বয়ং মেসি। তিনি জানিয়েছেন, ভক্তদের বানানো এটাই তাঁর শোনা সেরা গান।
এ গানে যেমন মেসি আছেন, তেমনই আছেন মারাদোনা। আর আছে সাড়ে ৪ কোটি দেশবাসীর বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। দেশের আপামর ফুটবলপ্রেমীকে উদ্বুদ্ধ করেছে ‘মুচাচোস’।
১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধে ব্রিটেনের মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। রক্তক্ষয়ী সে সংগ্রামে আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছিল। কিন্তু দেশের সেনাদের লড়াই ভুলে যাননি কেউ। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার সেই লড়াইয়ের কথাও রয়েছে বিশ্বকাপে মেসির দেশের এই ‘থিম সং’-এ।
‘মুচাচোস’-এ আর্জেন্টিনীয়দের তাতানোর জন্য রাখা হয়েছে ফুটবলের মাঠে তাঁদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কথাও। বিশ্বকাপ যাত্রায় আর্জেন্টিনাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছে সেই সেলেকাও-ছোঁয়া।
এই গানের কয়েক কলি বাংলায় অনুবাদ করলে হয়, ‘‘আমাদের আশা আবার জেগে উঠেছে। আমরা তৃতীয় কাপটাও জিততে চাই। আমরা হতে চাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।’’
গানটি যিনি লিখেছেন, তাঁর নাম প্রকাশ্যে এসেছে গানটি ভাইরাল হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই। তিনি হলেন ফের্নান্দো রোমেরো। আর্জেন্টিনার এই সমর্থক জানিয়েছেন, তাঁর এমন গান লেখার প্রেরণা কী।
২০২০ সালে মারাদোনার মৃত্যুর পর ২০২১-এ কোপা আমেরিকা জেতে আর্জেন্টিনা। সেই সময় এই গান বেঁধেছিলেন বলে জানিয়েছেন ফের্নান্দো। তিনি বলেন, ‘‘কোপা জেতার পর আমার মনে হয়েছিল, দিয়েগো আমাদের সঙ্গেই আছেন। তাই আমি এমন একটা গান বানাতে চেয়েছিলাম, যেখানে দিয়েগো থাকবেন। আমরা সকলে সেই গান গাইতে পারব।’’
মারাদোনাকে নিয়ে গানে লেখা হয়েছে, ‘‘আকাশ থেকে আমরা দিয়েগোকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি তাঁর মা এবং বাবার সঙ্গে বসে আমাদের দেখছেন। লিয়োনেলকে তিনি আরও এক বার বিশ্বকাপ জেতার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন।’’
অধিনায়ক হিসাবে একাধিক ফাইনাল খেলেছেন মেসি। বিশ্বকাপটাই কেবল তাঁর অধরা ছিল। রবিবার সে আশা পূরণ করলেন এলএম১০। তাঁর সঙ্গে স্বপ্ন ছুঁলেন সাড়ে ৪ কোটি আর্জেন্টিনীয় নাগরিক।
‘মুচাচোস’ রচয়িতা ফের্নান্দো জানিয়েছেন, ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জেতাই লক্ষ্য। তার পর এই গান আর কেউ কোনও দিন না গাইলেও তাঁর কোনও আক্ষেপ থাকবে না।
ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচের নির্ধারিত সময়ে খেলার ফলাফল ছিল ২-২। এর পর অতিরিক্ত সময়ে দুই দল আরও একটি করে গোল দিয়ে স্কোরবোর্ড পৌঁছে দেন ৩-৩। টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা জিতেছে ৪-২ ফলাফলে।
প্রিয় গানের তালে নাচতে নাচতেই বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে তুলে নিয়েছেন মেসি। আলভারেস, দি মারিয়ারা তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন, ভেসেছেন আবেগে। কাতারের মাঠে এ ভাবেই ইতিহাস লিখে ফেলেছে ‘মুচাচোস’।