২০১৭ সালে ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদি নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছে ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার। ২০১৮ সালে ইয়েমেনের আদালত তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। এই সাজায় অনুমোদন দিয়েছেন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট রাশাদ আল-আলিমি। সেই রায় নিয়ে বিচলিত গোটা দেশ। বিদেশ মন্ত্রকের কাছে সাহায্য চেয়েছে নিমিশার পরিবার।
সাত বছর ইয়েমেনের জেলে বন্দি অভিবাসী তরুণীকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা চলছে। ২০১৮ সাল থেকে আদালতে লড়াই চালাচ্ছিলেন প্রিয়া। নিম্ন আদালত থেকে লড়াই চালানোর পর সে দেশের শীর্ষ আদালতেও সেই মামলায় হেরে যান প্রিয়া। এরই মাঝে প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ডে অনুমোদন দিয়েছেন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট।
মেয়েকে বাঁচাতে ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইয়েমেনে যান নিমিশার মা। সেখান থেকেই ভারত সরকারের কাছে একাধিক বার মেয়ের প্রাণভিক্ষার আর্জি জানান তিনি। নিমিশার মা প্রেমা কুমারী দিল্লির উদ্দেশে বার্তা পাঠান, ‘‘শেষ বারের মতো অনুরোধ করছি, কিছু করুন। ওকে বাঁচান। সময় ফুরিয়ে আসছে। দয়া করে ওকে বাঁচান। এটাই আমার শেষ আবেদন।’’
গত মঙ্গলবার বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সরকার সব ধরনের সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘‘গোটা পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার ওয়াকিবহাল। নিমিশার পরিবারও সব রকম চেষ্টা করছে। সরকারও যথাসাধ্য সাহায্য করছে।’’
দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই মামলায় প্রথম থেকেই নিমিশার মুক্তির জন্য ভারত সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও চিঁড়ে ভেজেনি। ভারত ও ইয়েমেনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিছুটা জটিল। অভিযোগ সুয়েজ় খাল পেরিয়ে ভারতে আসা পণ্যবাহী জাহাজের উপর গোলাবর্ষণ করেছিল ইয়েমেন সরকার। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও বেশ নড়বড়ে। সরকার ও ইরানের মদতপুষ্ট বিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের আবহ জারি রয়েছে ইয়েমেনে।
সরকারের সমর্থনকারী দল হাদি ও বিরোধী গোষ্ঠীর হুথিদের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে ইয়েমেন দুই ভাগে বিভক্ত। বিরোধী গোষ্ঠীর হুথিরাই ইরানের সমর্থনে ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ, সেই সময় হুথিদের কব্জা করা অংশ থেকেই গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল ভারতীয় জাহাজের উপর।
সেই থেকেই ভারত-ইয়েমেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সে কারণে বিদেশ মন্ত্রক সাহায্যের আশ্বাস দিলেও সেই ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যাচ্ছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইয়েমেনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক দৌত্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রক সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে ফেরার নির্দেশও জারি করে।
এখনও সেখানে ভারতের কোনও প্রতিনিধি নেই। ভারতীয়দের ইয়েমেনে যেতেও ভিসার অনুমতি দেওয়া হয় না। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেন নিমিশা দেশে ফিরলেন না? কোন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পেতে চলেছেন তিনি? সত্যিই কি নিমিশাকে বাঁচানোর রাস্তা খোলা আছে সরকার ও তাঁর পরিবারের?
নিমিশার মুক্তির একটি ক্ষীণ আশা রয়েছে এখনও। সেই উপায় হল ‘ব্লাড মানি’। ইয়েমেনের আইন বলছে, টাকা দিয়ে মধ্যস্থতা সম্ভব। ইয়েমেনের সরকারের সঙ্গে নিমিশার পরিবারের মধ্যস্থতা করার জন্য এক আইনজীবীকে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা দাবি করেছেন। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণের জন্য ‘ব্লাড মানি’ হিসাবে আরও দেড় কোটি টাকা প্রয়োজন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর।
নিমিশার মুক্তির দাবিতে ২০১৮ সালে ভারতের এক সমাজকর্মী দীপা জোসেফ দিল্লি আদালতে আবেদন করেন। ইয়েমেনে অভিবাসী ভারতীয়দের একাংশ খুলেছেন ‘সেভ নিমিশা প্রিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন কাউন্সিল’। এই সংস্থাটি ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর মাধ্যমে নিমিশার মুক্তির জন্য অর্থ জমা করছে। বেশ কিছু অর্থ জোগাড় হওয়ার পর নানা জটিলতায় সেই উদ্যোগও বন্ধ হয়ে যায় বলে জানা গিয়েছে।
নিহতের পরিবারকে দিতে হবে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ বাবদ ‘ব্লাড মানি’। জোগাড় করতে পারলে নিমিশার মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য এতেই শেষ নয়। নিহত ব্যক্তি মাহদির পরিবার প্রাণভিক্ষা দিলে তবেই মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি পাবেন নিমিশা। সূত্রের খবর, ক্ষতিপূরণ নয়, নিমিশার শাস্তিই চেয়েছেন নিহতের পরিবার।
কেরলের পালাক্কড় জেলার বাসিন্দা নিমিশা পেশায় নার্স। ২০০৮ সাল থেকে ইয়েমেনের এক হাসপাতালে কাজ করতেন তিনি। কেরলে থাকতেই তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় টমি টমাস নামের এক ব্যক্তির। স্বামী টমি এবং মেয়েকে নিয়ে ইয়েমেনে চলে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিমিশার স্বামী এবং ১১ বছরের কন্যা ভারতে ফিরে এলেও তিনি সে দেশেই থেকে যান। স্বপ্ন ছিল নিজের ক্লিনিক খোলার।
আইন অনুযায়ী, ইয়েমেনে নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদারের দরকার ছিল নিমিশার। ওই বছরই ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। মাহদি তাঁকে নতুন ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দেন। ২০১৫ সালে দু’জন মিলে ক্লিনিকও খোলেন। এর পর থেকেই দুই অংশীদারের মতবিরোধ শুরু হয়।
অভিযোগ, নিমিশার টাকা কেড়ে নেন ওই যুবক। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ, মাহদি তাঁকে মাদকসেবনেও বাধ্য করেন। বিরোধ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেন মাহদি। লক্ষ্য ছিল নিমিশা যেন কোনও ভাবেই ইয়েমেন ছাড়তে না-পারেন।
আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন মাহদি। ফলে নিমিশার প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়া জটিল হয়ে পড়ে। অভিযোগ, একাধিক বার পুলিশের দ্বারস্থ হলেও কোনও লাভ হয়নি। মাসখানেক জেলে থাকার পরেই ছাড়া পেয়ে যান মাহদি। জেল থেকে বেরিয়ে নিমিশার জীবন আরও দুর্বিষহ করে তোলেন তিনি।
মাহদি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেখানকারই এক বন্ধুর পরামর্শে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই মাহদিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন ওই নার্স। নিমিশার দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজ়ের কারণে মৃত্যু হয় মাহদির। এর পর হানান নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মাহদির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে জলের ট্যাঙ্কে ফেলে দেন নিমিশা।
ওই মাসেই ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান নিমিশা। সেই থেকে ইয়েমেনের জেলেই বন্দি রয়েছেন ভারতের তরুণী। মাহদিকে হত্যার দায়ে ২০১৮ সালে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ইয়েমেনের আদালত। গত বছর নিমিশার সাজা মকুবের শেষ আবেদনও খারিজ হয়ে যায় সে দেশের সুপ্রিম কোর্টে। এর পর তাঁর প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করেন সে দেশের প্রেসিডেন্টও। ফলে নিমিশার প্রাণরক্ষার আশা এই মুহূর্তে অনেকটাই ক্ষীণ বলে মনে করা হচ্ছে।