রণনীতি ও সেনাবাহিনীর দিক দিয়ে সব দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকা আমেরিকা ভিয়েতনাম-যুদ্ধে (১৯৫৪-১৯৭৫) পরাজয়ের পর জোর ধাক্কা খায়। ৬০ হাজারের কাছাকাছি আমেরিকান সৈন্য প্রাণ হারান। অন্যান্য দেশের ক্ষেপণাস্ত্র, এয়ারক্র্যাফ্ট কী ভাবে বানানো হয়েছে, তা নিয়ে আমেরিকা সতর্ক হয়।
সেই সময় রাশিয়ার এমআইজি-২৫ বিমান যুদ্ধক্ষেত্রে সমস্ত দেশের নজর কেড়েছে। কিন্তু এই বিমানের প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে এ বিষয়ে সোভিয়েত সেনা থেকে শুরু করে সোভিয়েত সরকার উভয়েই নিশ্চুপ। সর্বোচ্চ গতিবেগের এই যুদ্ধবিমানের আর কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা অজানাই ছিল বাকি বিশ্বের কাছে।
রাশিয়াও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনও ভাবেই অন্য দেশের হাতে পড়তে দেবে না এই বিমান। পাইলটদেরও সেই মতো নির্দেশ দেওয়া ছিল। বিমানের অভ্যন্তরে একটি বোতাম থাকত, যা টিপলে বিমানটি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে অন্য কোনও দেশের হাতে বিমান পড়ার আশঙ্কা থাকলেই চালকদের ওই বোতামটি টেপার নির্দেশ দেওয়া হত।
যদি কখনও এমন পরিস্থিতি আসে যে এমআইজি-২৫ বিমান-সহ মাটিতে নামতে পাইলটদের বাধ্য করা হয়, সে ক্ষেত্রে ককপিট ছেড়ে বেরোনোর আগে বোতামটি টিপে দিতে হবে। ফলে কোনও দেশই এই বিমানের নাগাল পাবে না।
এমআইজি-২৫ নিয়ে রাশিয়ার এত রাখঢাক, নেটো আধিকারিকেরা এই বিমানের একটি গুপ্ত নাম রাখেন, তা হল— ‘ফক্সব্যাট’। অবশেষে রণে ভঙ্গ দিলেন রাশিয়ারই এক জন বিমানচালক। ভিক্টর ইভানোভিচ বেলেঙ্কো। চুগুইয়েভকা অঞ্চলের অন্তর্গত সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ফোর্সের ৫১৩ নং ফাইটার রেজিমেন্টের পাইলট ছিলেন তিনি।
কানাঘুষোয় শোনা যায়, আমেরিকার হাতে এই বিমানটি তুলে দিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু রাশিয়ার সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমে পৌঁছনো খুব সহজ কাজ নয়। ধন-ঐশ্বর্যের মোহ ত্যাগ করতে না পেরে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ভিক্টর।
জ্বালানির পরিমাণ, সময়, দূরত্ব সব দিক খেয়াল রেখে তিনি জাপানের হাকোদাতে বিমানবন্দরে নামবেন বলে ঠিক করেন। সেখান থেকেই আমেরিকানদের হাতে তুলে দেবেন এমআইজি-২৫ বিমানটি।
১৯৭৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ভিক্টর ফক্সব্যাট নিয়ে পাড়ি দেন জাপানের উদ্দেশে। কিন্তু বিমানটি বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেলেই রাশিয়ার হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই ১০০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে রেখে ভিক্টর বিমান চালাতে থাকেন। কিন্তু এত কম উচ্চতায় চালানোর জন্য জ্বালানির খরচও বেশি।
অবশেষে সি অব জাপানের কাছাকাছি পৌঁছনোর পর তিনি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেন। প্রায় আধ ঘণ্টা ওড়ার পর জাপানের এয়ারবেস তাঁর নজরে পড়ে। জাপানের ফ্যান্টম যোদ্ধারা বিমানটি লক্ষ করার পর তাঁকে সঠিক নির্দেশ দিয়ে নীচে নামিয়ে আনবেন এই ভেবে নিশ্চিত ছিলেন ভিক্টর।
কিন্তু ভিক্টরের বিমান জাপানের নজরে পড়লেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় বিমানটির আসল অবস্থান চিহ্নিত করতে পারছিলেন না। সামনে থেকে মেঘ কাটলে ভিক্টর রানওয়েটি দেখতে পান। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে রানওয়েতে আছড়ে পড়ে এমআইজি-২৫। এর ফলে বিমান-সংলগ্ন কয়েকটি অ্যান্টেনার তারও ছিঁড়ে যায়।
ভিক্টর পালানোর খবর রাশিয়ার কাছে পৌঁছলে তারা এমআইজি বিমানটি ফেরত চান। এমনকি, ভিক্টরকেও রাশিয়াতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলেন জাপান সরকারের আধিকারিকদের। কিন্তু রাশিয়ার অনুরোধ জাপান প্রত্যাখ্যান করে।
আমেরিকা যেন এত দিনে ‘সোনার খনি’র সন্ধান পেল। উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে নয়, ‘ফক্সব্যাট’ এখন তাদের সামনে। সঙ্গে ভিক্টরের চুরি করে আনা ম্যানুয়াল বইও। দীর্ঘ গবেষণার পর প্রচুর তথ্যের সন্ধান পায় আমেরিকা। বিমানের গতিবেগ, ওজন বেশি হওয়ার কারণ কী, তা জনসমক্ষে আসে। টাইটেনিয়ামের বদলে স্টিলের ব্যবহার করায় এই যুদ্ধবিমানের ওজন এত বেশি।
গতিবেগ বেশি হওয়ার কারণেও ইঞ্জিনের আয়ু ক্ষণস্থায়ী হয় বলে জানায় তারা। পরে অবশ্য বিমানের সব যন্ত্রপাতি ৩০টি কাঠের বাক্সে ভরে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। পরিবর্তে জাপান রাশিয়ার ৪০ হাজার আমেরিকান ডলার দাবি করে। কিন্তু সূত্রের খবর, রাশিয়া এই দাবি অস্বীকার করে। ভিক্টরও আর নিজের দেশে ফিরে যাননি।
তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। সেখানেই বিয়ে করে আবার নতুন করে সংসার পাতেন ভিক্টর। তিনি এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন।
শোনা যায়, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর ভিক্টর এক বার দেশে ফিরেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি আমেরিকায় সুখে রয়েছেন।
তবে ভিক্টরকে নিয়ে নানা কাহিনিও শোনা যায়। রুশ আধিকারিকদের মতে, ভিক্টর রাশিয়ায় ফিরে আসছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। অনেকে বলেন, রাশিয়ায় তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছিল। যদিও এই সব কাহিনির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।