তুঙ্গে ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন জটিলতা। তার মধ্যেই ভারতীয় সময় অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ইউক্রেন সীমান্তে আক্রমণ শুরু করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের সেনাকে অস্ত্র ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই এই পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে রয়েছে কোন কোন দেশ? ইউক্রেনকেই বা সমর্থন করছে কোন দেশগুলি।
রাশিয়া-ইউক্রেন জটিলতা নিয়ে প্রথম থেকেই সরব ছিল আমেরিকা। ইউক্রেনের দিকে রাশিয়া নজর দেওয়ার সময় থেকেই মস্কোর কড়া সমালোচনা করছে ওয়াশিংটন। তার পর বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া আক্রমণ শুরু করলে এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ ইউক্রেনে মৃত্যুমিছিল ডেকে আনবে। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলাকে ‘প্ররোচনাহীন এবং অযৌক্তিক’ বলেও নিন্দা করলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এর আগে রাশিয়াকে বারবার সতর্ক করেছে আমেরিকা। এ বার একেবারে যুদ্ধ শুরুর হওয়ায় আমেরিকা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তবে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সমর্থনেই এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ চিন। গত দু’দশক ধরে রাশিয়া এবং চিনের সম্পর্ক ভাল। এই দুই দেশই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে একে অপরের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত। এমনকি মহাকাশ গবেষণাতেও বহু দিন ধরে জোট বেঁধে কাজ করছে এই দুই দেশ। তাই এই পরিস্থিতিতে চিন, রাশিয়াকে সমর্থন না করলে একটু অবাকই হত অন্য দেশগুলি। রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উত্তর কোরিয়াও।
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের (নেটো) ৩০টি দেশ আগে থেকেই রাশিয়ার আক্রমণ রুখতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছিল। কিন্তু উভয়-সঙ্কটে রয়েছে রাশিয়া সীমান্তে থাকা জোটের দেশগুলি। বুলগেরিয়া, এস্টোনিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়ার মতো রাশিয়া সীমান্তের দেশগুলির উপর সামরিক জোটসঙ্গী হিসেবে একদা রাশিয়ার প্রভাব ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে ২০০৪ সালে আমেরিকা এই দেশগুলিকে নেটো-র অন্তর্ভুক্ত করে। রাশিয়ার একদম কাছে থাকা এই দেশগুলি নেটো-র অর্ন্তগত হলেও তাদের পক্ষে রাশিয়ার বিপক্ষে যাওয়া বেশ কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি সামলাতে নেটো সেনা রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়াতে মোতায়েন করা আছে। উল্লেখ্য যে, নেটো-র ৩০টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশের অবস্থানই রাশিয়ার কাছাকাছি।
তবে আমেরিকা-সহ নেটো-র অর্ন্তগত অনেক দেশ রাশিয়ার নিন্দা করলেও তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়াবে না বলেও পরিষ্কার করেছে। নিজেদের সৈন্যকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে না পাঠালেও এই দেশগুলি বাইরে থেকে অস্ত্র এবং ওষুধের মতো যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করবে। এমনকি নেটো দেশগুলির অনেক অস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে পৌঁছেছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমেরিকা এবং অন্যান্য নেটো দেশগুলির মতো নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি ইউরোপের দেশগুলি। নর্ড গ্যাসপাইপলাইন চুক্তি তার অন্যতম কারণ বলেই মনে করা হচ্ছে। এটি এমন একটি গ্যাস পাইপলাইন, যা রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ইউরোপের বিদ্যুৎক্ষেত্রে বড় ঘাটতির মুহূর্তে এই গ্যাস পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করলে মস্কো এই চুক্তি বাতিল করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে এই সব দেশ।
এই ভেবেই ইউরোপের নেটো দেশগুলি সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেতে চাইছে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। তবে নিজেগের ‘দু-মুখো’ তকমা ঘোচাতে সম্প্রতি জার্মানি এবং ফ্রান্সের প্রধানরা মস্কো গিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় তা নিয়ে আলোচনায় বসেন। তাতে যে বিশেষ লাভ হয়নি তা অবশ্য ইতিমধ্যেই প্রমাণীত।
ইউরোপের বাকি দেশগুলির তুলনায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে অনেক বেশি সরব ব্রিটেন। রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে বলেও কড়া বার্তা দিয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে রাশিয়ারই পক্ষ নিয়েছেন নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগা।
পরমাণু চুক্তি নিয়ে আমেরিকা এবং ইরানের সমস্যার বিষয়টি সারা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট। আমেরিকা-ইরান জটিলতার সন্ধিক্ষণ থেকেই তেহরানকে সমর্থন জুগিয়েছে রাশিয়া। তাই এই পরিস্থিতিতে ইরানও রাশিয়াকে সমর্থন করবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশগুলি।
তবে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন জটিলতা নিয়ে নিরপেক্ষ থাকার কথাই ঘোষণা করে এসেছে ভারত। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে গিয়েও কথাবার্তার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছিল ভারত। বিগত বেশ কিছু দশক থেকেই রাশিয়া এবং ভারতের সম্পর্ক ভাল বলেই গণ্য করা হয়। এমনকি ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময়ও দিল্লির সমর্থনে এসে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া।
তবে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি গোষ্ঠী (সিএসটিও)-র অর্ন্তগত দেশগুলি রাশিয়ার সমর্থনেই দাঁড়াবে। কাজাখস্তান, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, তাজিকিস্তানের এবং কিরঘিজস্তান, এই পাঁচ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও সিএসটিও-র মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এমনকি রাশিয়ার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আঘাতকে এই দেশগুলি নিজেদের উপর আঘাত বলে মনে করবে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবে বলেই স্পষ্ট।