শান্তির লেশমাত্র নেই। উল্টে নতুন বছরের শুরুতেই পশ্চিম এশিয়ার বাতাসে আরও বেশি করে মিশেছে বারুদের গন্ধ। এ বার লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকায় আছড়ে পড়ল আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র। এর মারণ প্রহার মনে করিয়েছে তিন দশক পুরনো উপসাগরীয় যুদ্ধের কথা। পাশাপাশি, এই রণাঙ্গনেও পর্দার আড়ালে থেকে চিনের কলকাঠি নাড়ার প্রমাণ মেলায় পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কম্যান্ড জানায়, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের নিকেশ করতে ‘টমাহক’ ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তাদের উপর হামলা করা হয়েছে। লোহিত সাগরে মোতায়েন ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’ বিমানবাহী রণতরীর স্ট্রাইক গ্রুপ শানিয়েছে এই আক্রমণ। উল্লেখ্য, পশ্চিম এশিয়ায় মোতায়েন ওয়াশিংটনের স্থল, বিমান এবং নৌসেনার যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেন্ট্রাল কম্যান্ডের হাতে।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের কোমর ভাঙতে গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) অক্টোবর থেকেই অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়েছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। এর আগে সশস্ত্র গোষ্ঠীদের গোপন ডেরায় ‘বি-২ স্পিরিট’ স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালায় ওয়াশিংটন। পাশাপাশি, লোহিত সাগরের কোলের দেশটিতে শোনা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াকু জেটগুলির গর্জনও। কিন্তু, তার পরও হুথিরা যে দমে যায়নি, পেন্টাগনের ‘টমাহক’ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে এই ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তৈরি করে আমেরিকা। ‘টমাহক’ মূলত একটি ভূমিতে আক্রমণকারী ক্ষেপণাস্ত্র (ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল)। যুদ্ধজাহাজ থেকে উড়ে গিয়ে উপকূলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আছড়ে পড়ার ক্ষেত্রে এর জুড়ি মেলা ভার। ‘টমাহক’কে যুক্তরাষ্ট্রের বিপজ্জনক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির অন্যতম বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। এর নির্মাণকারী সংস্থার নাম ‘আরটিএক্স কর্পোরেশন’।
অনেকেই ‘টমাহক’ ক্ষেপণাস্ত্রকে যুদ্ধের ‘খেলা ঘোরানো’ (গেম চেঞ্জার) হাতিয়ার বলে মান্যতা দিয়েছেন। ইরাকে জঙ্গিদের পুরোপুরি নির্মূল করতে আমেরিকার সৈনিকদের এর ব্যাপক ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা আনুমানিক ১,৬০০ কিলোমিটার। যুদ্ধজাহাজ ছাড়া ডুবোজাহাজ থেকে আক্রমণেও এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌসৈনিকরা।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ডেজ়ার্ট স্টর্ম’-এ নামে পেন্টাগন। সেই সময়ে বাগদাদের ফৌজের সামরিক ঘাঁটি এবং কম্যান্ড সেন্টার ওড়াতে এই ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করেছিল আমেরিকার সেনাবাহিনী। এর আঘাত সহ্য করতে পারেননি ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন। তাঁর দ্রুত পতনের নেপথ্যে ‘টমাহক’ বড় ভূমিকা নিয়েছিল বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
প্রায় ৩৪ বছর পর পশ্চিম এশিয়ায় ফের এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ভিডিয়ো প্রকাশ্য এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কম্যান্ড। আমেরিকার সেনাকর্তাদের দাবি, ‘টমাহক’-এর সাহায্যে হুথিদের হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদের গুপ্ত ভান্ডার উড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে। তবে হতাহতের কোনও সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।
আনুমানিক ২১ ফুট লম্বা এই ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন দেড় টন। এতে রয়েছে টার্বোজেট ইঞ্জিন। ক্ষেপণাস্ত্রটি ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে সক্ষম। জিপিএসের পাশাপাশে এতে টেরেন কনট্যুর ম্যাচিং প্রযুক্তি রেখেছেন আমেরিকার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে ১০০ ফুটের কম উচ্চতায় নেমে এসে হামলা চালায় ‘টমাহক’। অন্যান্য ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এটি কম উচ্চতায় ওড়ে। ফলে একে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন।
ইরান মদতপুষ্ট হুথিরা ইয়েমেনের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই কব্জা করে ফেলেছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) লোহিত সাগরে একাধিক মালবাহী জাহাজে হামলা চালিয়েছে তারা। পাশাপাশি ইজ়রায়েলকেও নিশানা করতে ছাড়েনি এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। এর পরই আসরে নামে আমেরিকা। লোহিত সাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যের রাস্তায় যাবতীয় প্রতিবদ্ধকতা দূর করতে সেখানে ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’ বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করে ওয়াশিংটন।
অন্য দিকে চিনের সঙ্গে হওয়া হুথিদের একটি গোপন চুক্তির কথা সম্প্রতি ফাঁস করেছে ইজ়রায়েলি সংবাদ সংস্থা ‘আই২৪নিউজ়’। তাদের দাবি, ইরান মদতপুষ্ট ইয়েমেনের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে লাগাতার হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ সরবরাহ করে যাচ্ছে বেজিং। বিনিময়ে লোহিত সাগরে ড্রাগনের কোনও মালবাহী বা ফৌজি জাহাজকে নিশানা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে হুথি যোদ্ধারা।
ইহুদি সংবাদ সংস্থার ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে যে, ব্যালেস্টিক এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে গোপনে সরবরাহ করছে চিন। সেগুলি ব্যবহার করে কয়েকশো ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারবেন হুথি যোদ্ধারা। মাটির কয়েক ফুট গভীরে বাঙ্কার বানিয়ে সেখানে এই ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের কাজ চলছে বলে দাবি করেছে ‘আই২৪নিউজ়’।
ইহুদিদের এই ফাঁস করা প্রতিবেদনকে মোটেই হালকা ভাবে নিচ্ছেন না আমেরিকার গোয়েন্দারা। ইতিমধ্যেই হুথিদের অস্ত্র সরবরাহকারী বেশ কয়েকটি চিনা হাতিয়ার নির্মাণকারী সংস্থাকে চিহ্নিত করেছে ওয়াশিংটন। ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আরও শক্তিশালী হলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই এই নিয়ে বেজিংয়ের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) গ্রীষ্মে চিন সফরে যান হুথির বেশ কয়েক জন শীর্ষ নেতা। সেখানেই এই চুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও গোটা বিষয়টি আগাগোড়া অস্বীকার করেছে বেজিং।
২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে লোহিত সাগরে হুথিদের বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে। ওই বছরের ৭ অক্টোবর তিন দিক থেকে ইজ়রায়েলে ঢুকে হামলা চালায় প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানাতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
হামাস-ইজ়রায়েল সংঘাতে প্যালেস্টাইনপন্থীদের পাশে এসে দাঁড়ায় হুথি। ইয়েমেন থেকে ইহুদি ভূমিতে চলে রকেট হামলা। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) সেই আক্রমণ অব্যাহত থেকেছে। ফলে বাধ্য হয়ে বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালায় আমেরিকা। এতে কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হন হুথি যোদ্ধারা।
লোহিত সাগরে হুথিদের দাপাদাপির জেরে বেশ কিছু মালবাহী জাহাজ ওই রাস্তা এড়িয়ে চলছে। ফলে গত অক্টোবরে এশিয়া এবং ইউরোপে পণ্য পরিবহণের খরচ ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে ভারতীয় জাহাজগুলির নিরাপত্তায় নৌসেনাকে ওই এলাকায় পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি।
লোহিত সাগর দিয়ে আনুমানিক ২৮ হাজার কোটি মূল্যের পণ্য পরিবহণ করে চিন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার বাজার ঠিক রাখতে হুথিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ড্রাগন। বেজিং চায় আমেরিকা, ভারত, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় দেশগুলির পণ্যবাহী জাহাজকে নিশানা করুক হুথি। এতে আখেরে লাভ হবে ড্রাগনের।
দ্বিতীয়ত, হুথিদের সাহায্যে পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কারণ তাঁর মূল লক্ষ্য হল তাইওয়ান দখল। লোহিত সাগরে আমেরিকার নৌসেনা ব্যস্ত থাকলে সেই কাজ সহজেই হাসিল করা যাবে বলে মনে করছে বেজিং।