হরেক রকমের প্লাস্টিকের টিফিন বাক্স। আমজনতার প্রায় প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়ে বাজারে চমক তৈরি করেছিল আমেরিকার সংস্থা ‘টাপারঅয়্যার ব্র্যান্ডস’। চাহিদা এমন ছিল যে জোগান দিয়ে কূল কিনারা পেত না সংস্থা। কিন্তু এ বার লালবাতি জ্বলতে চলেছে সেই সংস্থায়। মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে আমেরিকার সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে টাপারঅয়্যার ব্র্যান্ডস।
আমেরিকার সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট তথা সিইও লরি অ্যান গোল্ডম্যান বলেছেন, “আর্থিক ভাবে আমরা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশলগত বিকল্প খতিয়ে দেখা হয়েছে। কিন্তু দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। এটাই এই মুহূর্তে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা বলে মনে হয়েছে।”
গত কয়েক বছর ধরেই টাপারঅয়্যারের তৈরি সামগ্রীর বিক্রি কমছিল। ফলে আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে আমেরিকার সংস্থা। গত বছর যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটিকে সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। দ্রুত অবস্থার উন্নতি না হলে সংস্থা আর্থিক ভাবে টিকে থাকতে পারবে না বলেও স্পষ্ট করেছিলেন তাঁরা।
আমেরিকার দেউলিয়া আইনের ১১ নম্বর চ্যাপ্টার অনুযায়ী আবেদনপত্র জমা করেছে টাপারঅয়্যার। ব্র্যান্ডকে সুরক্ষিত করতে এটা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে টিফিন বাক্স নির্মাণকারী সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, ব্র্যান্ডটি বিক্রির অনুমোদনও চেয়েছে এই সংস্থা। যা পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনগত জটিলতা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই বিষয়ে মুখ খুলেছেন সংস্থার সিইও গোল্ডম্যান। তাঁর কথায়, “আমরা গ্রাহকদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে চাইছি। তাঁদের কাছে উচ্চ মানের পণ্য পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।” যদিও , টাপারঅয়্যারের সামগ্রী আর খুব বেশি দিন বাজারে দেখা যাবে না বলেই অনুমান বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
১৯৪৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় টাপারঅয়্যারের পথচলা। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আর্ল টাপার। ম্যাসাচুসেটসের লিওমিনস্টারে প্লাস্টিকের একটি কারখানা তৈরি করেন তিনি। তখন অবশ্য মন্দার কবলে পড়েছিল গোটা দেশ। ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে ইতিহাসে রয়েছে যার উল্লেখ। তৎকালীন মন্দা কিন্তু টাপারঅয়্যারের সাফল্যে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা টাপারের জন্ম আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে। সালটা ছিল ১৯০৭। পড়াশোনায় টাপার যে বরাবরই দুর্দান্ত ছাত্র ছিলেন, তেমনটা নয়। কিন্তু ছোট থেকেই তাঁর ছিল নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা। স্কুলের খাতায় বেল্ট লাগানো চিরুনি ও মাছের নৌকার স্কেচ এঁকেছিলেন তিনি।
টাপারের এই ধরনের আবিষ্কার তাঁকে একেবারেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দেয়নি। ফলে পরবর্তী কালে প্লাস্টিকের ব্যবসায় নামেন তিনি। লিওমিনস্টারে যখন টাপার নিজের সংস্থা প্রতিষ্ঠায় মগ্ন, তখন আর্থিক মন্দা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল আমেরিকার তৎকালীন সরকার। টাপার নিজের কারখানার জন্য যে জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন, তা শিল্পের হাব হিসাবে পরিচিত ছিল।
প্রথম দিকে প্লাস্টিকের সাবান ও সিগারেট কেস তৈরি করত টাপারের সংস্থা। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর টাপারঅয়্যার ব্যবসায় অন্য গতি আসে। ওই সময় রাসায়নিক সামগ্রীর সংস্থা ‘ডুপন্ট’ বাজারে নিয়ে আসে পলিথিন নামের নতুন ধরনের একটি সামগ্রী। রাডার তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল এই পলিথিন। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘোরাতে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
ডুপন্টের তৈরি এই পলিথিন খুব দ্রুত বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকার বহু সংস্থা এটিকে প্যাকেজিং ও খেলনা তৈরির জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। সেই তালিকায় নাম ছিল টাপারঅয়্যারেরও।
১৯৪৬ সালে রান্নাঘরের প্লাস্টিকের সামগ্রী তৈরি শুরু করে আর্ল টাপারের সংস্থা। তাঁর সংস্থার ‘বিস্ময় বাটি’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিল করা বিশেষ ধরনের এই বাটিতে দীর্ঘ ক্ষণ খাবার রাখা যেত। সিল করার সময়ে এতে গরম হাওয়া বাইরে বার করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল।
ম্যানহাটনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে রান্নাঘরের সামগ্রী বিক্রি করতেন টাপার। এ ছাড়া ছিল নিজস্ব শো-রুম। তবে প্রথম দিকে ধীর গতিতে সেগুলি বিক্রি হচ্ছিল। ওই সময়ে ব্রাউনি ওয়াইজ় নামে ফ্লোরিডার এক মহিলা ‘প্যাটিও পার্টিজ’ নামের একটি সংস্থা চালাতেন।
টাপারঅয়্যার নতুন সংস্থা হওয়ায় তার তৈরি সামগ্রী সাধারণ আমেরিকানরা খুব একটা কিনতে চাইতেন না। প্লাস্টিকের রান্নাঘরের সামগ্রী কী ভাবে কাজ করবে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তাঁরা। এই আবহে পৃথক সংস্থার মালকিন হওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে আসেন ব্রাউনি ওয়াইজ়। নিখরচায় টাপারঅয়্যারের সামগ্রী ব্যবহারের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দেন তিনি। কাচ ও সিরামিকের চেয়ে প্লাস্টিকের থালা-বাটির ব্যবহার কতটা সুবিধাজনক, তা-ও সবাইকে বোঝান তিনি।
ওয়াইজ়ের এই কৌশল কাজে লেগেছিল। আমেরিকার জনপ্রিয় ম্যাগাজ়িন ‘স্মিথসোনিয়ানের’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর পর থেকেই টাপারঅয়্যারের সামগ্রী বিক্রি হু হু করে বাড়তে শুরু করে। এক সপ্তাহে এক জন মহিলা এই সংস্থার ৫৬টি বাটি কিনেছিলেন।
ওয়াইজ়ের এই সাফল্যের কথা কানে যেতেই নড়েচড়ে বসেন আর্ল টাপার। সময় নষ্ট না করে সংস্থার মার্কেটিং দফতরের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ফ্লরিডাবাসী ওই মহিলাকে নিয়োগ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে টাপারঅয়্যারের সঙ্গে যুক্ত হন ওয়াইজ়।
১৯৫৩ সালে অরল্যান্ডোর দক্ষিণে ফ্লরিডার কিসিমিতে ১ হাজার ৩০০ একর জমি কেনেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা আর্ল টাপার। ওই জায়গাটা তখন ছিল ছোট্ট একটা খামারশহর। ওই জমিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় টাপারঅয়্যারের সদর দফতর।
এর এক বছরের মাথায় প্লাস্টিকের রান্নাঘরের সামগ্রী নির্মাণকারী সংস্থাটির ব্যবসা আড়াই কোটি ডলারে পৌঁছয়। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা জুড়ে বহু সংস্থাই টাপারঅয়্যারের ব্যবসার মডেলকে ধ্রুবতারা মেনে চলত।
১৯৫৮ সালে টাপারের সংস্থা থেকে বরখাস্ত হন ওয়াইজ়। কোম্পানির ব্র্যান্ডের মুখ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। ওই বছরই ওষুধ বিক্রির চেন সংস্থা রেক্সালের কাছে ৯০ লক্ষ ডলারের স্টক বিক্রি করে দেয় সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে টাপারওয়্যারের ব্যবসা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে ব্রিটেনের বাজার ঢুকে পড়ে এই সংস্থা। সংশ্লিষ্ট সংস্থায় আমেরিকার মহিলাদের অংশীদারি বাড়ছিল। ১৯৫৪ সালে এতে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৪ শতাংশ। যা ২০০০ সালে ৬০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল।
২০২০ সালে করোনা অতিমারী শুরু হলে আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে এই কোম্পানি। রান্না ঘরের সামগ্রী বিক্রি তলানিতে চলে আসে। সেই জায়গা থেকে টাপারঅয়্যার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শেষে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে এই সংস্থা।