সম্প্রতি তিন দিনের আমেরিকা সফর সেরে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নৈশভোজের পাশাপাশি এই তিন দিন একাধিক কর্মসূচি ছিল তাঁর।
আমেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সঙ্গে তাঁর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে উঠে এসেছে মহাকাশ থেকে প্রতিরক্ষা, টেলিযোগাযোগ থেকে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ। নিরাপত্তা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতার নতুন সেতু তৈরি করেছে ভারত, আমেরিকা।
আমেরিকায় মোদীর খাতিরের অভাব হয়নি। বাইডেনদের সঙ্গে নৈশভোজ, ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ, এলাহি আয়োজন হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য।
মোদীও ‘মিত্র’ দেশটিকে উপহারে ভরিয়ে দিয়েছেন। বাইডেনকে তিনি দেন মাইসুরুর বিখ্যাত চন্দনকাঠের তৈরি একটি বাক্সের মধ্যে রাখা আইরিশ কবি উইলিয়ম বাটলর ইয়টসের অনুবাদ করা উপনিষদ।
মোদী, বাইডেনদের এই দেওয়া-নেওয়ায় আমেরিকা এবং ভারতের পারস্পরিক সম্পর্কের আভাস ফুটে ওঠে। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে মোদীর সফরে। স্বাক্ষরিত হয়েছে একাধিক চুক্তি।
গত পাঁচটি অর্থবর্ষের মধ্যে চারটিতেই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সঙ্গী হিসাবে উঠে এসেছে আমেরিকার নাম। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এই দুই দেশের মধ্যে ১২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
কিন্তু আমেরিকা আর ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের শুরুটা এমন ছিল না। বর্তমানে খাতির করলেও একসময় ভারতকে নিতান্ত অবজ্ঞার চোখেই দেখত আমেরিকা। ধাপে ধাপে সেই সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।
১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারেই ভাল ছিল না। প্রকাশ্যে ভারতের সমালোচনা শোনা যেত আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখে।
শোনা যায়, ভারত প্রসঙ্গে নিক্সন নাকি বলেছিলেন, ‘‘ওই দেশের মহিলারা পৃথিবীর সবচেয়ে কম আকর্ষণীয়, এতে কোনও সংশয় নেই।’’ ভারতের এই অপমান নিয়ে সত্তরের দশকে কম জলঘোলা হয়নি।
আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্রমোন্নতি ঘটে নব্বইয়ের দশক থেকে। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন পিভি নরসিংহ রাও। ওই বছরই ভারত বিশ্বের কাছে তার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেছিল।
রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে ৫৪২ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন হয়। নরসিংহ রাওয়ের আমলে এই লেনদেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
নরসিংহ রাওয়ের আমলে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক বৃদ্ধির হার ছিল ১২.৬৭ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে তাঁর সময়কাল শেষের বছরে দুই দেশের মধ্যে ৯৮৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়।
১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় বার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সে সময় আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১২২০ কোটি ডলার।
বাজপেয়ীর জমানায় ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই দুই দেশের মধ্যে ১০.৮ শতাংশ হারে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাজপেয়ী।
২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিংহ। এই ১০ বছরেও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক বৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো।
২০০৪ সালে দুই দেশের মধ্যে ২২৫৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। ২০১৪ সালে মনমোহন যখন কুর্সি ছাড়েন, তখন বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৮৫৯ কোটি ডলার। এ সময় বাণিজ্য বাড়ে তিন গুণ।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন মোদী। তাঁর আমলে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক বৃদ্ধির হার ৯.২ শতাংশ।
গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনের গ্রাফ লাগাতার ঊর্ধ্বমুখী।
মাঝে এক বার দুই দেশের বাণিজ্যিক বৃদ্ধি নুইয়ে পড়েছিল বটে। তবে আমেরিকা মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠলে ২০১০ থেকে ২০১৪-র মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আবার জোয়ার আসে।
বর্তমানে আমেরিকার অন্যতম বাণিজ্যিক সঙ্গী ভারত। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রেও ভারত এবং আমেরিকা একে অপরের উপর নির্ভরশীল।