পশ্চিম এশিয়ায় এ বার তালিবানি শাসন? ভূমধ্যসাগরের কোলে জন্ম নিচ্ছে দ্বিতীয় আফগানিস্তান? বিদ্রোহীদের হাতে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। শুধু তা-ই নয়, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের আগুনে এতে আরও বেশি পরিমাণে ঘি পড়ল বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস দখল করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনী। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আসাদ প্রাণভয়ে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। এর পরই তালিবানের সঙ্গে এইচটিএসের তুলনা টেনে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই তালিবান এবং এইচটিএসের মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। তাত্ত্বিক দিক থেকেও দু’টি সশস্ত্র গোষ্ঠীতে বেশ কিছু মিল রয়েছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয় বার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ভারত-সহ বিশ্বের বহু দেশ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এইচটিএসকে একই সমস্যার মুখে পড়তে হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
আমেরিকা বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের (ইইউ) চোখে এইচটিএস জঙ্গি সংগঠনের বাইরে কিছু নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদও সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে এই একই তকমা দিয়েছে। ফলত, তাঁদের তৈরি দামাস্কাসের তদারকি সরকারকে যে দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর দেশগুলির থেকে মান্যতা পেতে রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
দামাস্কাস দখলের পর তদারকি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব মহম্মদ আল-বশিরের কাঁধে দিয়েছে এইচটিএস। আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১ মার্চ পর্যন্ত ওই পদে থাকবেন তিনি। আসাদের শাসনকালেই উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া এবং ইদলিব দখল করে পশ্চিম এশিয়ার এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। ওই এলাকায় সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে বশিরের। আর তাই দামাস্কাসের কুর্সিতে তিনিই ছিলেন এইচটিএসের ‘অটোমেটিক চয়েস’।
আসাদকে সরিয়ে সিরিয়া দখল করা ইস্তক উন্নয়ন এবং প্রগতির কথা বলছে পশ্চিম এশিয়ার এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০২১ সালে কাবুল কব্জা করার পর তালিবানের গলাতেও ছিল এই একই সুর। ওই সময়ে হিন্দুকুশের কোলে একটি অন্তর্বর্তিকালীন সরকার তৈরি করে তারা। আমু দরিয়ার তীরের জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়েছিল তালিবান।
কিন্তু সময় গড়াতেই আফগানদের কাছে স্পষ্ট হয় তালিবানের আসল চেহারা। গণতন্ত্র তো দূর অস্ত্, মৌলবাদকেই লাগাতার প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে কাবুলের শাসক গোষ্ঠী। পাশাপাশি তালিবানের শীর্ষ নেতৃত্বের গলাতেও শোনা গিয়েছে জেহাদের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকারের কথা। অন্য সমস্ত গোষ্ঠী বা দলকে নিশ্চিহ্ন করে আফগানিস্তানকে তাঁরা যে একক ভাবে শাসন করতে চান, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
তালিবান শাসনে বার বার প্রশ্নের মুখে পড়ছে আফগানিস্তানের নারী এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার। মহিলাদের স্কুল-কলেজে যাওয়া একরকম বন্ধই করে দিয়েছে কাবুলের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী। পাশাপাশি, শরিয়া আইন মেনে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের নিয়ম চালু হয়েছে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে। পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের উপরেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সিরিয়ায় এইচটিএসের শাসন মজবুত হলে সেখানে আফগানিস্তানের ছবিই দেখা যাবে। কারণ আদর্শগত ভাবে তালিবানের মতোই জেহাদে বিশ্বাস করে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। মৌলবাদ, কট্টরপন্থা এবং শরিয়া শাসনের মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এইচটিএসের সংগঠন। কুর্সিতে বসে সেখান থেকে তাঁদের সরে আসা একরকম অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, তালিবানের মতোই লম্বা সময় ধরে আমেরিকার সঙ্গে লড়াই চালিয়েছে এইচটিএস। যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজকে তাড়াতে আফগানিস্তানের পাথুরে জমি প্রায় ২০ বছর ধরে রক্তে ভিজিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা। এইচটিএস অবশ্য সেটা শুরু করে ইরাকে। পরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
এ ছাড়া ওয়াশিংটনের পয়লা নম্বর শত্রু আল-কায়দা জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যথেষ্ট মাখামাখি রয়েছে তালিবান এবং এইচটিএসের। একটা সময়ে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটির শক্ত ঘাঁটি ছিল আফগানিস্তান। আর সরকারে থাকার সুবাদে তাঁদের দু’হাতে আগলে রেখেছিল তালিবান। অন্য দিকে আল কায়দারই একটা উপদল থেকে জন্ম নিয়েছে এইচটিএস। সে দিক থেকে এইচটিএসকে আল আকয়দার ‘সন্তান’ বলা যেতেই পারে।
২০১১ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে সিরিয়ায় বেধে যায় গৃহযুদ্ধ। লড়াই শুরু হওয়ার আগেই পশ্চিম এশিয়ায় নুসরা ফ্রন্ট নামের একটি সংগঠন তৈরি করে আল কায়দা। সিরিয়া এবং ইরাকে তখন উল্কার গতিতে উঠে আসছে ইসলামিক স্টেট নামে আর এক জঙ্গি গোষ্ঠী। আর সেটা একদম না-পসন্দ ছিল আল-কায়দার। ইসলামিক স্টেটের দৌড় থামাতেই নুসরা ফ্রন্টকে কাজে লাগায় তারা।
এইচটিএসের মূল মাথা বললেই উঠে আসবে আবু মহম্মদ আল-জোলানির নাম। একটা সময়ে নুসরা ফ্রন্টের হয়ে ইরাকে অস্ত্র ধরেছিলেন তিনি। পরে ২০১৬ সালে আল-কায়দার সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে সিরিয়ায় তৈরি করেন নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী। দামাস্কাসের পতনের পর পুরনো সংগঠন নিয়ে বিষোদ্গার করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। আল-কায়দার মতো কখনওই তাঁর দল নারী, শিশু ও নিরীহদের নিশানা করে না বলে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন জোলানি।
তবে দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় অমিলও রয়েছে। প্রথমত, এইচটিএস দেশ শাসনের ক্ষেত্রে মৌলবাদের বদলে মধ্যপন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী। সংখ্যালঘু, বিশেষত ভূমধ্যসাগরের তীরে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের প্রতি এই গোষ্ঠীটির যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে। তাঁদের সুরক্ষার ব্যাপারে একাধিক বার জোলানির দলকে প্রকাশ্যে প্রচার করতেও দেখা গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তালিবানের মতো মধ্যযুগীয় শরিয়া আইনে বিশ্বাসী নয় এইচটিএস। বরং তুরস্কের আদলে সিরিয়ার শাসনযন্ত্রকে গড়ে তুলতে চায় এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। পশ্চিম এশিয়ায় অটোমান আমলের খলিফার রাজত্ব ফেরানোর স্বপ্ন রয়েছে জোলানির দলের। আর সেই কারণেই এইচটিএসকে অনেক বেশি আধুনিক কট্টরপন্থী সংগঠন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
তৃতীয়ত, বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা করছে তালিবান। সূত্রের খবর, জঙ্গি তালিকা থেকে কাবুলের শাসকদের নাম বাদ দিতে চলেছে মস্কো। অন্য দিকে সিরিয়ার ছবি এর ঠিক উল্টো। সেখানে আসাদকে ক্ষমতায় ফেরাতে মরিয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এইচটিএসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গোপনে দামাস্কাসের সাবেক শাসকের অনুগত বাহিনীকে সাহায্য করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ভবিষ্যতে সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিশে যাবে এইচটিএস। নিজেদের অস্তিত্ব মুছে জঙ্গি তকমা ঝেড়ে ফেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ই হবে তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। তবে সে ক্ষেত্রে সহযোগী অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সমর্থন কতটা জোলানির দল পাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তা ছাড়া আগামী দিনে সিরিয়ার টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যেই গোলান মালভূমির (গোলান হাইটস্) দিক থেকে দেশটির বেশ কিছুটা জমি দখল করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইজ়রায়েল। অন্য দিকে ক্ষমতা হারানোর আড়াই সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যাঘাত শানিয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আসাদের অনুগত ফৌজ। সে দিক থেকে তালিবানি শাসন অনেক বেশি মজবুত। আফগানিস্তান ভেঙে নতুন দেশ তৈরির সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।