বোলার পেটানোর সময় তিনি যে বিশেষ উচ্চবাচ্য করতেন, তেমনটা বোধ হয় সচিন তেন্ডুলকরের সম্পর্কে বলা যায় না। মাথা গুঁজে ক্রিজে পড়ে থাকার সময় বিপক্ষ ফুট কাটলেও হেলদোল থাকত না সচিনের। ব্যাটেই জবাব দিতেন। এক বার তেমনই কড়া জবাব দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পেসার গ্রেন ম্যাকগ্রাকে। সেই সঙ্গে ম্যাকগ্রাকে তাঁরই দাওয়াই দিয়েছিলেন।
২০০০ সালে নাইরোবির মাঠে বসেছিল আইসিসি নকআউট ট্রফির আসর। ২০০২ সালের পর যার নাম বদলে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি করা হয়েছিল। সে বছরের ৭ অক্টোবর ৫০ ওভারের ওই টুর্নামেন্টে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। যে ম্যাচের বাধা কাটালে সোজা সেমিফাইনালে যেত বিজয়ী দল।
শেষ আটে অসিদের হারাতে সচিন ছাড়াও অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভরসা ছিলেন রাহুল দ্রাবি়ড়ের মতো পোড়খাওয়া ব্যাটার।
সচিনদের সঙ্গে দলে ছিলেন বিনোদ কাম্বলি এবং অবশ্যই যুবরাজ সিংহ নামে ১৮ বছরের এক আনকোরা ব্যাটার। ওই টুর্নামেন্টেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে যাঁর এক দিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। যদিও অভিষেক ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পাননি তিনি। তবে বল হাতে ১৬ রান খরচ করে ১টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন।
টিম ইন্ডিয়ার হয়ে বোলিং ওপেন করার দায়িত্ব ছিল জ়াহির খান এবং বেঙ্কটেশ প্রসাদের উপর। অজিত আগরকর সামলাতেন মাঝের ওভারগুলি। তাঁদের পাশে লেগস্পিনের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সামাল দিতে রবিন সিংহকেও দেখা গিয়েছিল সে ম্যাচে।
স্টিভ ওয়ের নেতৃত্বে অসিদের দলটিও কম ওজনদার ছিল না। মার্ক ওয়, অ্যাডান গিলক্রিস্টের ব্যাটে ওপেন করতে নেমেছিলেন সে ম্যাচে। ছিলেন রিকি পন্টিং, মাইকেল বিভান এবং ডেমিয়েন মার্টিনের মতো ব্যাটার।
ম্যাকগ্রাকে যোগ্য সঙ্গত করতে ব্রেট লি এবং জেসন গিলেসপির মতো জোরে বোলারদের সাহায্যে শেন লি এবং ইয়ান হার্ভিকেও প্রথম একাদশে রাখা হয়েছিল।
নাইরোবির ওই ম্যাচে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার লড়াইয়ের পাশাপাশি ম্যাকগ্রা বনাম সচিনের দ্বৈরথ দেখতেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দর্শক। তাঁদের পয়সা উসুল করেই যেন দ্বৈরথ শুরু করেছিলেন দুই তারকা।
টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অসি অধিনায়ক ওয়। সৌরভের সঙ্গে ব্যাটিং ওপেন করতে নেমে সচিনের ‘অন্য’ খেলাও দেখেছিলেন দর্শকেরা।
ভারতের প্রথম উইকেট নেওয়ার জন্য সচিনের দিকে বিষাক্ত সুইং মেশানো বল ছুড়তে শুরু করেছিলেন ম্যাকগ্রা। তার কয়েকটিতে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেননি সচিন। এর পরেই সচিনের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করেছিল অসিদের স্লেজ়িং।
সচিনের বিরুদ্ধে বল করার সময় ‘সুভাষণ’ও শুরু করে দিয়েছিলেন ম্যাকগ্রা। তাতে কি মাস্টার ব্লাস্টারকে দমানো যায়? ম্যাকগ্রার কটূক্তির বদলে সচিনের জবাব মূলত এসেছিল তাঁর ব্যাটের মাঝখান থেকে। ম্যাকগ্রাকে কিছু কথাও শুনিয়েছিলেন সচিন।
ম্যাচের তৃতীয় ওভারেই ম্যাকগ্রার বলকে তুলে খেলে বাউন্ডারির অনেক উঁচু দিয়ে বাইরে পাঠিয়েছিলেন সচিন। এর পরের ছয় এসেছিল ৪.২ ওভারে। উইকেট ছেড়ে কিছুটা বাইরে এসে আম্পায়ারের মাথার উপর দিয়ে বিশাল ছয়।
ম্যাকগ্রার প্রথম ২টি ওভারে ১টি করে ছয়ের শেষেও ঝড় থামাননি সচিন। তাঁর তৃতীয় ওভারে আরও ১টি ছয় মারেন। তত ক্ষণে অবশ্য ম্যাকগ্রার ছন্দ বিগড়ে গিয়েছিল। ইনিংসের গোড়াতেই সচিনের রুদ্রমূর্তিতে ছন্দ বেঁধে নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া।
৩ ওভারে ৩টি ছয়ের পর অবশ্য বিশেষ এগোতে পারেননি সচিন। ৩৭ বলে ৩৮ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফিরেছিলেন। ৩টি ছয়ের সঙ্গে ওই সংখ্যক চারও মেরেছিলেন সচিন।
সংক্ষিপ্ত ইনিংস খেললেও ম্যাকগ্রাকে সে দিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কটূক্তির উত্তর কী ভাবে ব্যাট দিয়ে দিতে হয়। তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১০২.৭। সে দিন সব মিলিয়ে ৬১ রান খরচ করে কোনও উইকেট নিতে পারেননি ম্যাকগ্রা।
ভারতের ইনিংসে সচিন-সৌরভ (৪২ বলে ২৪ রান)-এর ৬৬ রানের ওপেনিং জুটি ভেঙে গেলে দ্রাবিড় এবং কাম্বলিও জলদি আউট হয়ে যান।
ভারতকে আরও এক বার ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন যুবরাজ। ৫ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৮০ বলে ৮৪ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংস খেলেন তিনি। তাতে ছয় না থাকলেও ছিল ১২টি চার। মূলত তাঁর ইনিংসের জোরে ৯ উইকেটে ২৬৫ রান তোলে ভারত।
জেতার দৌ়ড়ে নেমে ৪৬.৪ ওভারে ২৪৫ রানেই থেমে গিয়েছিলেন অসিরা। পন্টিং (৫৯ বলে ৪৬ রান), বিভান (৫২ বলে ৪২), গিলক্রিস্ট (২৩ বলে ৩৩)-এর সঙ্গে লোয়ার অর্ডারে ব্রেট লি (২৮ বলে ৩১) ছাড়া বিশেষ কেউ ভারতীয় বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। জ়াহির, বেঙ্কটেশ এবং আগরকর মিলে ২টি করে উইকেট তুলে নেন।
ওই ম্যাচ জিতে টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন সৌরভ-সচিনরা। তবে ম্যাকগ্রা বনাম সচিনের মাঠের লড়াই নিয়ে আজও ভেসে ওঠে সংবাদমাধ্যম।