ইউক্রেন যুদ্ধে এ বার সরাসরি জড়াতে চলেছে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির শক্তিজোট? ‘নেটো’-র সামরিক কমিটির চেয়ারম্যানের কথায় মিলল তেমনই ইঙ্গিত। বিষয়টি কানে আসতেই পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে মস্কো। ফলে আগামী দিনে ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেল্সে ‘ইউরোপীয় নীতি কেন্দ্রে’ হওয়া একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নেটোর সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল রব বাউয়ের। সেখানে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করার কথা বলেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যের পরই রণাঙ্গনে মস্কো বনাম নেটোর মল্লযুদ্ধের জল্পনা তীব্র হয়েছে।
ব্রাসেল্সের অনুষ্ঠানে অ্যাডমিরাল বাউয়ার বলেন, ‘‘নেটোভুক্ত দেশগুলি একটা প্রতিরক্ষা শক্তিজোটে রয়েছে। ফলে আপাতত রুশ আক্রমণের অপেক্ষায় আমাদের চুপ করে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু যে মূহূর্তে মস্কোর দিক থেকে তির ছুটে আসবে, সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে গুলি করে নামানো হবে।’’
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরও বেশি আক্রমণাত্মক হলে তার ফল যে ভাল হবে না, সেই হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন নেটোর নৌসেনা আধিকারিক। অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে ‘মস্কো আগুন নিয়ে খেলছে’ বলে মন্তব্য করেন অ্যাডমিরাল বাউয়ার। প্রয়োজনে রাশিয়ার অনেকটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালানোর কথাও তাঁর কণ্ঠে শোনা গিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা ‘নিউজ়উইক’-এর করা প্রশ্নের উত্তরে নেটোর সেনাকর্তা বলেন, ‘‘তিরন্দাজকে খতম করার সহজ উপায় হল তার উৎসকেই গুঁড়িয়ে দেওয়া। মস্কো আমাদের উপর মূলত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাবে। সেই উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলিকে ধ্বংস করলেই প্রেসিডেন্ট পুতিন সামরিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়বেন।’’
এর পরই আরও একধাপ এগিয়ে আক্রান্ত হওয়ার আগেই নেটোর ‘ঘুষি’ মস্কোর মুখে পড়বে বলে জানিয়ে দেন অ্যাডমিরাল বাউয়ার। শুধু তা-ই নয়, আত্মরক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও দাবি করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই নেটোভুক্ত দেশগুলি যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
নেটোর ফৌজি অফিসারের ওই মন্তব্যের পরই পাল্টা হুমকি দেন রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লেভেরভ। মস্কোর সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘তাস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘অ্যাডমিরাল বাউয়ার যাবতীয় সহ্যের সীমা পেরিয়ে গিয়েছেন। রাশিয়াকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হলে আমরাও চরম পদক্ষেপ করতে পিছপা হব না।’’
চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর হাজারতম দিনে পা রাখে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পাওয়া ‘আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ (এটিএসিএমএস) দিয়ে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এলাকায় হামলা চালায় কিভ। আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) দিয়ে পুতিনের সেনা প্রত্যাঘাত শানালে পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে।
গত ২১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় শহর ডেনিপ্রোতে আছড়ে পড়ে রুশ আইসিবিএম ‘ওরেশনিক’। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে গোটা শহর। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে লাগাতার চলে বিস্ফোরণ। মস্কোর এই ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের তেজে কাঁপুনি ধরেছে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত নেটোভুক্ত দেশে।
‘অপারেশন ডেনিপ্রো’র কিছু ক্ষণের মধ্যেই টিভিতে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘নতুন ধরনের প্রথাগত মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে (ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইআরবিএম) হামলা চালানো হয়েছে। শব্দের ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে সেটি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে।’’
রুশ প্রেসিডেন্টের দাবি সত্যি হলে সেকেন্ডে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে ‘ওরেশনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র। আর তাই কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) পক্ষে একে চিহ্নিত করে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা অসম্ভব, বলেছেন ক্রেমলিনের রাষ্ট্রপ্রধান।
অন্য দিকে, ইউক্রেনের ফৌজি গুপ্তচর বিভাগ ‘ওরেশনিক’কে নতুন ধরনের আইসিবিএম বলে উল্লেখ করেছে। তাদের দাবি, রাশিয়ার আস্ট্রাখান এলাকা থেকে এটিকে ছোড়ে পুতিন ফৌজ, ডেনিপ্রো থেকে যার দূরত্ব প্রায় হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল)। লক্ষ্যে আঘাত হানতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় নিয়েছে ‘ওরেশনিক’।
কিভের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, শব্দের চেয়ে ১১ গুণ গতিতে উড়ে এসে হামলা চালায় ওই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। মোট ছ’টি ওয়ারহেডে সজ্জিত ছিল ‘ওরেশনিক’। সেগুলির প্রতিটি থেকে আবার ডেনিপ্রোর উপর আছড়ে পড়ে ছ’টি করে বিস্ফোরক ভর্তি হাতিয়ার। ইউক্রেনীয় শহরকে ধূলিসাৎ করার ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে মস্কো।
এর পাশাপাশি রুশ পরমাণু নীতিতে (নিউক্লিয়ার ডকট্রিন) বড় বদল এনেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ফলে আণবিক হাতিয়ার না থাকা দেশের উপরেও পরমাণু হামলা চালাতে পারবে মস্কো। ক্রেমলিন জানিয়েছে, পরমাণু শক্তিধর কোনও দেশের থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত শত্রু রাষ্ট্রের উপরে প্রয়োজনে আক্রমণ চালানো হবে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, পুতিনের পরমাণু নীতি বদল এবং ওরেশনিকের ক্ষমতা চাক্ষুষ করার পরই আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না নেটোর সেনাকর্তারা। রাশিয়া যাতে আর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ না করতে পারে, সেই পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
কারণ হিসাবে দু’টি যুক্তি দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। প্রথমত, রুশ ফৌজের হাতে রয়েছে ‘এস-৪০০’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। একে টপকে মস্কোর ক্ষেপণান্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্র হামলা করা বেশ কঠিন। দ্বিতীয়ত, আক্রমণ হলে পুতিনের প্রত্যাঘাতে যুদ্ধের আঁচে পুড়তে পারে গোটা ইউরোপ।
গত ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘নেটো’ দেশগুলিকে নতুন করে হুমকি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তাঁর অস্ত্রাগারে দূরপাল্লার ‘ব্রহ্মাস্ত্রের’ যে কোনও অভাব নেই, ‘ওরেশনিক’ ব্যবহার করে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন পুতিন। এই পরিস্থিতিতে নেটোর পদস্থ সেনাকর্তার এ হেন মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
অনেকে আবার অ্যাডমিরাল বাউয়ারের কথায় ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ আশঙ্কা করছেন। কারণ, নেটো প্রকৃতপক্ষে একটি সৈন্য চুক্তি। এর প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র সামরিক ভাবে একে অপরকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে পুতিন নেটোভুক্ত কোনও দেশে হামলা চালালে বাকি রাষ্ট্রগুলিও চুক্তির নিয়ম মেনে মস্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
নেটোর নেতৃত্বে রয়েছে আমেরিকা। এই শক্তিজোট আক্রান্ত হলে ওয়াশিংটনকেও নামতে হবে যুদ্ধের ময়দানে। অন্য দিকে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে মস্কো। যুদ্ধের সময়ে চিন ও ইরানের সাহায্য পাবেন বলেও আশাবাদী পুতিন। তখন এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশের নতুন নতুন রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে সংঘর্ষ।
এই পরিস্থিতিতে নাগরিকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে ইউরোপের ‘স্ক্যান্ডেনেভিয়া’ এলাকার চারটি দেশ। সেগুলি হল নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ড। রুশ আক্রমণের আতঙ্কে দেশ জুড়ে বাঙ্কার নির্মাণে জোর দিয়েছে জার্মান সরকার। পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স।
এ বছরের নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আসন্ন জানুয়ারিতে শপথ নেবেন তিনি। ক্ষমতা পেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি ভোট প্রচারেই দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে কার্যভার গ্রহণের পর এ ব্যাপারে তিনি কী পদক্ষেপ করেন সেটাই এখন দেখার।