সে যখন আকাশে ওড়ে, তখন তার রাজকীয় হাবভাব তাক লাগিয়ে দেয়। তাক তো লাগারই কথা! কারণ তাকে বলা হয় ‘আকাশের রানি’। পেল্লায় চেহারা। বিশ্বের প্রথম বড় বিমানের তকমা অনেক আগেই অর্জন করে নিয়েছে ‘বোয়িং ৭৪৭’। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বিমান। অর্ধশতক বাদে অবশেষে শেষ বার এই বিমান তৈরি করা হল।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনের কারখানা থেকে বার করা হয়েছে শেষ তৈরি বোয়িং ৭৪৭ বিমান। এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরই অনেকেই অতীতচারী। আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন বিমান সংস্থার সঙ্গে যুক্তরা।
১৯৬৭ সালে প্রথম শুরু হয়েছিল বোয়িং ৭৪৭ বিমানের উৎপাদন। প্রায় ৫৪ বছর ধরে তৈরি হয়েছে বিশ্বের এই বড় উড়ান। মোট ১৫৭৪টি বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি করা হয়েছে।
শেষ যে বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি তৈরি করা হয়েছে, সেটি ২০২৩ সালে অ্যাটলাস এয়ার সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে। তার আগে বিমানটির পরীক্ষামূলক ভাবে মহড়া চালাবেন বোয়িং সংস্থার প্রশিক্ষক পাইলট। তার পর রং করা হবে বিমানটির।
বোয়িং ৭৪৭ গত কয়েক দশক ধরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করে আসছে। ‘আকাশের রানি’ তকমা দেওয়ার পাশাপাশি এই বিমানকে ‘জাম্বো জেট’ও বলা হয়ে থাকে।
আর চার-পাঁচটা সাধারণ বিমানের থেকে বোয়িং ৭৪৭-এর নকশা অনেকটাই আলাদা। এই বিমানে চারটি ইঞ্জিন রয়েছে। রয়েছে দু’টি করিডর। একসঙ্গে প্রায় ৫০০ জন যাত্রীকে নিয়ে উড়তে পারে এই বিমান।
১৯৭০ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে আকাশে ওড়ে এই বিমান। এই ধরনের উড়ানের সামনের অংশে কুঁজ রয়েছে। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে আভিজাত্যের প্রতীক বহন করে চলেছে বোয়িং ৭৪৭।
এই সব বিমানে রয়েছে ককটেল লাউঞ্জ। যা লম্বায় ৭০ মিটার ও ৬০ মিটার প্রশস্ত। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা এই বিমানে চড়ে থাকেন।
যে বিমানের এত বহর, তার উৎপাদনে কেন ইতি টানা হল? বিমান সংস্থাগুলি চাইছে, জ্বালানি কম লাগে, এমন অত্যাধুনিক উড়ান তৈরি করা হোক। করোনা অতিমারির কয়েক বছর আগে বোয়িং ৭৪৭ বিমান ব্যবহার বন্ধ করেছে ইউনাইটেড ও ডেল্টা। অতিমারির সময় ‘জাম্বো জেট’কে বিদায় জানিয়েছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও কান্তাসের মতো বিমান সংস্থাগুলি।
ইতিহাসের পাতায় বোয়িং ৭৪৭ উড়ানের উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যে অন্ধকার দিকও রয়েছে। বহু বারই দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হয়েছে ‘আকাশের রানি’কে।
২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, ৬১টি বোয়িং ৭৪৭ বিমান দুর্ঘটনা ও বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছিল। মোট ৩ হাজার ৭২২ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে।
১৯৭০ সালে প্রথম বার বিপত্তির মুখে পড়েছিল এই বিমান। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর প্যান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৬ উড়ান অপহরণ করে প্যালেস্তাইনের ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন’।
আমস্টারডাম থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাচ্ছিল বিমানটি। অপহরণকারীরা বিমানটিকে প্রথমে বেইরুটে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে কায়রোতে নিয়ে যান তাঁরা। কায়রো পৌঁছনোর পর যাত্রীদের সরিয়ে বিমানটিকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর প্রথম বার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল এই বিমান। নাইরোবি থেকে টেক-অফের পর ভেঙে পড়েছিল লুফথানসার বোয়িং ৭৪৭ বিমান। দুর্ঘটনায় ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
১৯৮৫ সালের ২৩ জুন ভারতের হাতে থাকা একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭ বিমান ‘কণিষ্ক’ কানাডার মন্ট্রিয়াল থেকে লন্ডন হয়ে মুম্বই আসছিল। বোমা বিস্ফোরণের জেরে বিমানটি অতলান্তিক মহাসাগরে ভেঙে পড়ে। বিমানের ক্রু সদস্য, যাত্রী-সহ মোট ৩২৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
দুর্ঘটনা, নাশকতার ঘটনার মতো কালো দাগ গায়ে লাগলেও বোয়িং ৭৪৭ বিমানের ঐতিহ্যে চিড় ধরেনি। আর সে কারণেই ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রানির মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে এই উড়ান। শেষ বার এই বিমানের উৎপাদন হওয়ায় যেন এক যুগের অবসান ঘটল।