উচ্ছ্বাস, উল্লাস, কানফাটানো চিৎকার, চোখের জল, অবিশ্বাস, অবশেষে বিশ্বাস। পেরেছেন, মেসিরা পেরেছেন। গঞ্জালো মন্টিয়েলের ডান পায়ের শটটা হুগো লরিসকে ঠকিয়ে গোলপোস্টে ঢুকতেই মধ্যরাতের কলকাতা মিশে গেল বুয়েনস আইরেসের ফ্যাকাসে নীল-সাদা রঙে। শুধু কি তিলোত্তমার মেসি-ভক্তেরা, রবিবার লিয়োনেল মেসিদের সঙ্গে বিশ্বকাপ জয়ের আবেগে ভাসল বেঙ্গালুরু থেকে বার্সেলোনা, কোচি থেকে কেপটাউন, কোপাকাবানা থেকে হাইতি।
কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে ফ্রান্সের গাঢ় নীল-সাদা রং ছাপিয়ে মেসিদের রং ফুটে উঠতেই বেঙ্গালুরুর বহু রাস্তায় রাজত্ব করেছে আর্জেন্টিনা। মেসির কাটআউট, হাতে পোস্টার। বেঙ্গালুরুর মৃদু শীত উপেক্ষা করে এ ভাবেই ভিড় বাড়িয়েছেন মেসি-ভক্তেরা। তুমুল চিৎকারে অনেকের রাতের ঘুম উড়িয়েছেন তাঁরা। তবে এমন দিন তো বার বার আসে না!
রবিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে হাতে তোলার আগেই বিশ্বকাপের মাথায় চুম্বন এঁকে দিয়েছেন মেসি। কাপ কোলে নিয়ে এমন আদর করেছেন, যেন তার সন্তান! তেমনঅ পরম মমতায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছেন বার্সেলোনার মেসি-ভক্তেরা। অনেকেরই চোখে-মুখে তখনও অবিশ্বাস। তাঁদের শহরের ক্লাবের হয়েই তো এই সে দিন পর্যন্ত লা লিগা মাতিয়ে রেখেছিলেন এই ফুটবলশিল্পী।
দক্ষিণ আফ্রিকার রাস্তায়ও উপচে পড়েছে মেসি সমর্থকদের ভিড়। কাতারে কাতারে লোকজন নেমেছে কেপটাউনের পথেঘাটে। উড়েছে আর্জেন্টিনার পতাকা। ওই ভিড়ে ফুটে উঠেছে একটি খুদের দু’হাতে ঢাকা মুখ। যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, তার ফুটবল-ঈশ্বরের হাতে বিশ্বকাপ উঠেছে।
বার্সেলোনার মতো স্পেনের অন্য শহরেও উল্লাসে মেতেছেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। আবেগের জোয়ারে ভেসেছে স্পেনের ছোট্ট শহর গুয়েরনিকাও। উল্লাসের মাঝে অনেকেই প্রিয়জনকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছেন। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হারের ধাক্কা কাটিয়ে শেষমেশ বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা! এ যে অবিশ্বাস্য!
মেসিদের জয়ের উৎসবে শামিল হয়েছে ক্রিকেটপাগল ক্যারিবিয়ানও। হাইতির রাস্তায় আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে ফ্যাকাসে নীল-সাদা জার্সি গায়ে চিৎকার থেকে নাচ-গান— সবই দেখা গিয়েছে।
মেসি যেন তাঁদের ঘরের ছেলে। মেসিদের প্রতিটি ম্যাচে রাতের পর রাত জেগেছে কেরলের পাড়ার পর পাড়া। চেয়ার পেতে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়েছেন পাড়ার আট থেকে আশিরা। কিলিয়ান এমবাপেকে ছাপিয়ে গিয়ে মেসি নিজের ঘরে কাপ নিয়ে যাবেন, এর পর কি চুপচাপ বসে থাকা যায়! আতশবাজি ফাটিয়ে তা উদ্যাপন করেছে কোচি।
তিরুঅনন্তপুরমে আবার বড়দিনের আগেই সান্টা ক্লজ়ের উপহার পেয়ে গিয়েছেন মেসি-ভক্তেরা। রাত বাড়লেও রাস্তায় রাস্তায় ভিড় পাতলা হয়নি। বরং তা আরও বেড়েছে। অনেকে আবার সাউন্ড বক্স হাতে রাস্তাতেই পার্টি শুরু করে দিয়েছেন।
স্পেনের যে শহরের হয়ে লা লিগায় খেলে সবচেয়ে বেশির গোলের (৪৭৪) রেকর্ড দখলে নিয়েছেন মেসি, সেই মাদ্রিদের এক মেসি-ভক্তের তখনও ঘোর কাটেনি। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, ৩৫ বছরেও মারাদোনার মতো ম্যাজিক দেখিয়েছেন মেসি।
৩৫ বছরের ছোটখাটো চেহারার নায়ক অবশেষে আকাশ ছুঁয়েছেন। নায়কের ছেঁড়াফাটা কাটআউট হাতে বুয়েনস আইরেসের রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে এক খুদে মেসি-ভক্ত। কাটআউটের পাশ দিয়ে স্মিত অথচ অর্থবহ হাসি ঠিকরে পড়ছে।
২৮ দিনের লড়াইয়ের শেষে অবশেষে বিশ্বজয়ের স্বাদ। বাজি ফাটিয়ে, জার্সি উড়িয়ে সে জয়ের উৎসবে মেতেছেন মেসির দেশের মানুষজন। শোরগোলের ফাঁকে ট্র্যাফিক লাইটের স্তম্ভে চড়েছেন অনেকে। অনেকে আবার সেখানে চড়ে প্রিয়তমার ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দিয়েছেন।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে বার বারই তুলনা মেসির টানা হয়েছে। মেসি কি একার হাতে কাপ এনে দিতে পারবেন? রবিবার সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছেন মেসি। কাতার বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের সম্মানে বুয়েনস আইরেসের রাস্তা ভরে উঠেছে। সঙ্গে মারাদোনার মুখ আঁকা বিশাল পতাকা নিতেও ভোলেননি মেসি-ভক্তেরা।
৩৬ বছর পর বিশ্বকাপের দখল নিয়েছেন মেসিরা। পার্টি তো হবেই। বিয়ারের বোতল হাতে নাচে-গানে শহর মাতিয়েছেন বুয়েনস আইরেসের বাসিন্দারা।
আর্জেন্টিনার রাজধানীর রাস্তায় পার্টি যেন থামতেই চাইছে না। বাজির ধোঁয়ায় মিলেমিশে গিয়েছে মিউ়জ়িকের আওয়াজ। জমিয়ে পার্টিতে সুরার ফোয়ারাতেও নিজেদের ডুবিয়েছেন ফ্যাকাশে নীল সাদা জার্সির সমর্থকেরা।
ফাইনাল শুরুর আগে থেকেই বুয়েনস আইরেসের পাবগুলিতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। তবে সকলেরই চোখ ছিল টিভির পর্দায়। পেনাল্টি শ্যুটআউটে মন্টিয়লের গোলের জয়ের দৌঁড় শুরু হতেই সমস্বরে গলা ফাটিয়েছেন তাঁরা।
শুধু কি পাব, তিলধারণের জায়গা নেই বুয়েনস আইরেসের রাস্তায়ও। প্রায় সকলেই জাতীয় দলের ফুটবল জার্সিতে। মেসিদের উপর বিশ্বাস রাখার ফল মিলেছে তাঁদের।
কাতারের বিশ্বকাপে মেসি-নেমার মুখোমুখি দ্বৈরথের সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষমেশ তা হয়নি। তবে মেসিদের চিরশত্রুদের ঘরেও তো আর্জেন্টিনার সমর্থক রয়েছেন। তাঁরাও সাও পাওলোর রাস্তায় ভিড় বাড়িয়েছেন। কারও হাতে নকল বিশ্বকাপ। কারও হাতে মেসির পুতুল।
আর্জেন্টিনার জয়ের পর ভিড়ে ভিড়াক্কার কোপাকাবানার সমুদ্রসৈকতেও খুশির জোয়ার। অনেকে আবার নকল বিশ্বকাপ হাতে নিজস্বীতে উৎসবের মুহূর্তকে বন্দি করেছেন।
মেসি-এমবাপের ডুয়েল দেখার যাবতীয় প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়েছিলেন এ শহরের বহু বাসিন্দা। রাস্তায় বড়সড় টেলিভিশনে লাগিয়েছিলেন। শীতের রাতে তার সামনে বসে ভিড়ের প্রার্থনা চলছিল— মেসিরা যেন কাপ হাতে তোলেন।
অবশেষে স্বপ্নপূরণ! এ বার কি আর ঘরে থাকা যায়? শীতের কনকনানি উপেক্ষা করে পাড়ার অনেকেই রাস্তায় নেমে পড়েছেন। উড়িয়েছেন মেসিদের দেশের পতাকাও।
ফাইনালে ব্রাজিল নেই তো কী হয়েছে? মেসিদের অন্ধ ভক্তেরা তো রয়েছেন। পাড়ার দখল নিয়েছিল আর্জেন্টিনার রং-মাখা মুখেরা।