এক ধনকুবের এবং তাঁর স্ত্রীকে তাঁদের বাড়িতে ঢুকে খুন করা হল, অথচ ৫ বছর পরও সেই খুনিকে ধরার সাধ্যি হল না কোনও ফেলুদা-ব্যোমকেশ বা শার্লক হোমসের। মাথা খাটানোর সুযোগ, ঢালাও পুরস্কারের টোপ— কোনও কিছুতেই হয়নি রহস্যোদ্ঘাটন।
নিহত ধনকুবের ছিলেন বিশেষ প্রভাবশালী। নামী ওষুধ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। কানাডার টরন্টোর বাসিন্দা ওই শিল্পপতি দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বন্ধুও। তবে সেই প্রতিপত্তি খুনিকে ধরার ক্ষেত্রে খাটেনি। কোনও অজানা উপায়ে গত ৫ বছর ধরে পুলিশের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছেন হত্যাকারী।
নিহত ওই ব্যবসায়ীর নাম ব্যারি শেরম্যান। ওষুধের সংস্থা অ্যাপোটেক্সের প্রতিষ্ঠাতা ব্যারি এবং তাঁর স্ত্রী হানিকে রহস্যজনক ভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁর বাড়িতেই। তাঁকে উদ্ধার করেন তাঁরই বাড়িতে অতিথি হয়ে আসা এক জমি-বাড়ির দালাল।
ব্যারি এবং হানি দু’জনেরই দেহ পাওয়া গিয়েছিল বাড়ির ভিতরের সুইমিং পুলের পাশে।
ধনকুবের ব্যারি এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনেরই পরনে ছিল ধোপদুরস্ত পোশাকআশাক। পাশাপাশি আধবসা অবস্থায় ছিলেন দু’জনে। কিন্তু দু’জনেরই গলায় অত্যন্ত শক্ত করে ফাঁস দেওয়া হয়েছিল চামড়ার বেল্টের।
বেল্টের এক প্রান্ত বাঁধা ছিল গলায় অন্য প্রান্তটি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল পুলের রেলিংয়ের গায়ে। এ ভাবেই পাশাপাশি বসা অবস্থায় দু’জনকে উদ্ধার করা হয় পুলের ধার থেকে।
বেল্টে হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। মেলেনি জুতোর ছাপও। খুনিকে ধরার প্রাথমিক সূত্রগুলিই খুঁজে পাননি তদন্তকারীরা। ঘটনাটি কানাডাতে তো বটেই সে সময় হইচই ফেলে দিয়েছিল শিল্পমহলেও।
১৯৭৪ সালে অ্যাপোটেক্স নামে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্যারি। সেই সংস্থাকেই একার পরিশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিলেন শীর্ষে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কানাডার অন্যতম বড় ওষুধ সংস্থা হিসাবে। এ দিকে শিল্পপতি হিসাবে নাম হয়েছিল ব্যারির। তাঁর সংস্থা তত দিনে শুধু দানেই ব্যয় করেছে ৫ কোটি ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪১৪ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সস্ত্রীক ধনকুবেরকে। ব্যারি এবং হানি ছিলেন সে সময় কানাডার ধনীতম দম্পতি। তাঁদের মোট সম্পত্তির মূল্য ছিল ৩০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ২৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা।
এর থেকে অনেক কম সম্পত্তির জন্যও বহু খুনের ঘটনা ঘটেছে। ব্যারির সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী ছিলেন। ব্যারির অবর্তমানে তাঁর দুই সন্তান— পুত্র জোনাথন শেরম্যান এবং কন্যা অ্যালেক্স ক্রসজিকের ওই সম্পত্তি পাওয়ার কথা ছিল।
জোনাথন বলেছেন, ‘‘আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়লে দুঃস্বপ্ন মনে হয় আমার। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাবা-মাকে হারানোর যন্ত্রণা, সামনে বিপুল অনিশ্চয়তা, সংস্থার নিয়ন্ত্রণ সব কিছু নিয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম।’’
দিন কয়েক আগে এই জোনাথনই তাঁর বাবা-মায়ের খুনিকে ধরার জন্য বিপুল পুরস্কারের অর্থ ঘোষণা করেছেন।
পাঁচ বছর আগে পুরস্কারের অঙ্ক ছিল ১ কোটি ডলার। সম্প্রতি সেই পুরস্কারের অর্থ বাড়িয়ে ৩.৫ কোটি ডলার করার ঘোষণা করেছেন ব্যারির পুত্র। যা ভারতীয় মুদ্রায় ২৯০ কোটি টাকার সমান।
জোনাথন বলেছেন, ‘‘এই ডিসেম্বরে আমার বাবা-মায়ের হত্যার ৫ বছর পূর্ণ হবে। পাঁচ বছরে খুনিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ঠিকই কিন্তু আমি খোঁজ বন্ধ করব না। কারণ যত দিন না খুনিকে খুঁজে শাস্তি দেওয়াতে পারছি, তত দিন আমার বাবা-মা সুবিচার পাবেন না।’’
কিন্তু ৫ বছরে খুনিকে তো দূর, খুনের কারণই খুঁজে পায়নি পুলিশ। গত বছরই এক মাঝবয়সি ব্যক্তির একটি আবছা ছবি প্রকাশ করে পুলিশ কানাডার জনগণকে অনুরোধ করেছিল, এই খুনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এঁকে ধরতে সাহায্য করুন। পুলিশ এ-ও জানিয়েছিল যে, ওই ব্যক্তির সঙ্গে ধনকুবেরের খুনের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছে তারা। তার পরও অবশ্য ওই ব্যক্তি সম্পর্কে কোনও তথ্য হাতে আসেনি পুলিশের। খুনিকে চিহ্নিত করা যায়নি।
ব্যারির অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ট্রুডো। ছিলেন কানাডার অন্টারিয়ো প্রদেশের প্রাক্তন প্রধানও। দু’জনেই আশ্বাস দিয়েছিলেন ব্যারির হত্যার তদন্ত দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু ৫ বছরেও পূরণ হয়নি সেই প্রতিশ্রুতি।
খুনের তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল, ঘটনাটি হয়তো হত্যা করে আত্মহত্যার ঘটনা। অর্থাৎ ব্যারিই নিজের স্ত্রীকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন বা উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু ময়নাতদন্তে জানা যায়, এ ভাবে আত্মহত্যা অসম্ভব। তা ছাড়া খুনের সময় ব্যারির বয়স ছিল ৭৫। তাঁর স্ত্রীর বয়স ৭০। দু’জনের কেউই এই বয়সে ওই ভাবে বলপ্রয়োগ করে খুন করতে সমর্থ হতেন না। ফলে পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায় পরিকল্পনা করে খুনই করা হয়েছে দু’জনকে।
ব্যারির কন্যা অ্যালেক্সও এই রহস্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ৫ বছর হয়ে গেল। অথচ এখনও বহু প্রশ্নের উত্তর নেই। তদন্তে কোনও অগ্রগতিও নেই। কী করে এটা সম্ভব?
টরন্টো পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, তাঁরা এই মৃত্যুরহস্যের সমাধান করতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য যত দূর চেষ্টা করা সম্ভব তত দূর যেতে রাজি তাঁরা। যদিও সমালোচকরা বলছেন এমন একটি হাই প্রোফাইল হত্যার সমাধান করতে এত সময় লাগার কথা নয়। ভিতরে কোনও গলদ আছে বলেই দেরি হচ্ছে।