দেশে আবার চোখ রাঙাতে শুরু করেছে করোনা। করোনার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরাও। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের নতুন উপরূপ জেএন.১। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই উপরূপের সংক্রমণই দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই উপরূপের সম্পর্কে দেশবাসীর মধ্যে এখনও কোনও স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়নি।
জেএন.১ করোনা ভাইরাসের বিএ.২.৮৬ ওমিক্রন প্রজাতির একটি উপপ্রজাতি। আমেরিকার ‘ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’ জানিয়েছে, ওমিক্রন এবং ওমিক্রনের বংশধর জেএন.১ রূপ দু’টি প্রায় অভিন্ন। ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য ছাড়া আর বিশেষ কোনও তফাৎ নেই কোভিডের দুই উপরূপে। তাই এটিও এক শরীর থেকে অন্য শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
আমেরিকায় কোভিড সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্যও জেএন.১-কে দায়ী করেছে সিডিসি। সিডিসি-র পর্যবেক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিক্রম করে শরীরে আরও ভাল ভাবে বাসা বাঁধতে সক্ষম করোনার নয়া উপরূপ। তবে এখনও তা প্রমাণিত হয়নি।
সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, অর্থাৎ, ক্লান্তি, মাথাব্যথা, কাশি, জ্বর, জেএন.১-এর সংক্রমণেও মোটামুটি একই লক্ষণ দেখা যায়।
করোনার টিকা এই উপরূপের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিজ্ঞানীদের মত, জেএন.১-কে দুর্বল করতে সক্ষম করোনার টিকা। করোনার নয়া রূপ ঠেকাতে টিকা কার্যকর হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিডিসি জানিয়েছে, কোভিডের বুস্টার টিকা ওমিক্রন উপরূপকে পরাস্ত করতে তৈরি করা হয়েছিল। প্রাথমিক গবেষণা অনুযায়ী, সেই টিকা মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তা জেএন.১-কে ঠেকাতেও সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার বুস্টার টিকা সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকাতে না পারলেও প্রাণহানির সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দেবে।
১৩ ডিসেম্বর একটি বিবৃতিতে, হু-র টিকা উপদেষ্টা কমিটি জানিয়েছে, জেএন.১-এর বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে আপাতত বুস্টার টিকাই ব্যবহার করা উচিত।
পাশাপাশি, জেএন.১-কে ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট’ হিসাবেও ব্যাখা করেছে হু। হু-র দাবি, এই উপরূপে সংক্রমণের ফলে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। তা ছাড়া এই উপরূপটি আগের উপরূপের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর নয় বলেও দাবি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।
চিনে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন করোনার জেএন.১ উপরূপে আক্রান্ত। করোনার এই উপরূপটি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল লুক্সেমবার্গে। গত অগস্ট মাসে প্রথম এই উপজাতির খোঁজ মেলে।
ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকায় যে ক’জন কোভিড রোগী এই মুহূর্তে আছেন, তাঁদের ১৫-২৯ শতাংশের দেহে রয়েছে জেএন.১ উপরূপ।
এর মধ্যে ভারতেও আবার ভয় ধরাতে শুরু করেছে করোনা। এখনও পর্যন্ত সারা দেশে করোনার জেএন.১ উপরূপে ২১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। গোয়া, কেরল এবং মহারাষ্ট্র— এই তিন রাজ্যেই আপাতত করোনার নয়া রূপের কোপ পড়েছে।
সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১ জনের মধ্যে শুধু মাত্র গোয়াতেই ১৯ জন আক্রান্ত। কেরল এবং মহারাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছেন এক জন করে।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া তথ্যেই জানা গিয়েছে, গত সাত মাসে দেশে সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে বুধবার। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬১৪ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন দেশে। শেষ গত ২১ মে এই সংখ্যা ছুঁয়েছিল করোনা সংক্রমণ।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, কেরলে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা এখন ১,৭৪৯। সম্প্রতিই কর্নাটকে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। কেরলের পর এই প্রথম অন্য রাজ্যে মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এল।
করোনা সংক্রমণের এই সাম্প্রতিক বৃদ্ধির নেপথ্যে করোনা ভাইরাসের নতুন উপরূপকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবীয়। বুধবার সকালে উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য আধিকারিকদের পাশাপাশি, রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আসন্ন উৎসবের মরসুমে কেরলে কোভিড সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে চিন্তিত কেন্দ্র।
যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তার উপসর্গ গুরুতর নয়। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তবুও বছর শেষে উৎসবের মরসুমে কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না সরকার।
আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যগুলিকে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে, এই সংক্রমণ যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ করতে হবে। জ্বর এবং সর্দিকাশি নিয়ে যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হচ্ছে, তাঁদের উপর বিশেষ নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলাভিত্তিক রিপোর্ট চাওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
বিশেষ ভাবে সতর্ক করা হয়েছে কেরল লাগোয়া অঞ্চলগুলিকে। রোগ নির্ণয় করতে পরীক্ষা বৃদ্ধি করার উপর জোর দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। ইন্ডিয়ান সার্স-কোভ-২ (আইএলএসএসিওজি) বলছে, কেরলে জেএন.১ প্রজাতির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশেও মিলেছে এই প্রজাতির খোঁজ।