অগত্যা দত্তক নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাইছেন?
ইচ্ছে থাকলে নিজেই সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। একা একাই। সোজা কথায় হতে পারেন বায়োলজিকাল মা। শুনতে সোনার পাথরবাটি মনে হলেও বাস্তবে এটাই হচ্ছে। আসলে সন্তানের জন্মের জন্য চাই মা’র ডিম্বাণু আর বাবার শুক্রাণু। এ ক্ষেত্রে সঙ্গীর অভাবে দাতা শুক্রাণুর সাহায্য নিয়েই হতে পারেন ‘কুমারী মা’।
গত বছর এই ভাবেই কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন স্প্যানিশ মডেল-অভিনেত্রী মনিকা ক্রুজ। সে সময় বছর ছত্রিশের মনিকা মনের মতো সঙ্গী খুঁজে পাননি। অথচ মা হতে চেয়েছিলেন। তাই বেছে নিয়েছিলেন প্রজননের কৃত্রিম পদ্ধতি।
মনিকার মতো এমন অনেক মেয়েই আছেন, যাঁরা সময় মতো সঙ্গীর খোঁজ পাননি। অথচ বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তাই বলে কি তাঁরা মা হতে পারবেন না? আজকের প্রজন্ম ব্যাপারটাকে দেখছেন অন্য ভাবে। দত্তককে একমাত্র উপায় না ভেবে ওঁদের অনেকেই এগিয়ে আসছেন একাই সন্তানের জন্ম দিতে। মনিকার মতো সেলিব্রেটিরা যেমন তালিকায় আছেন, তেমনই আছেন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও। কলকাতায়ও ইতিমধ্যে বেশ কিছু অবিবাহিত মহিলা এই ভাবেই মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন।
সময়ই শেষ কথা
আসলে মেয়েদের একটি বায়োলজিকাল ক্লক থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাণু ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে থাকে। ৩৫-এর পর যে সব ডিম্বাণু অবশিষ্ট থাকে, তাদের অনেকেরই গুণমান ভাল নয়। তার জন্য বেশি বয়সে সন্তান হলে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হতে পারে। এমনকী গর্ভপাতও হতে পারে। সে জন্য বলা হয় পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর মাতৃত্বের আসল সময়। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে সবার জীবন যে রুটিনমাফিক চলবে, তা তো নয়। সে ক্ষেত্রে উপায় বিকল্প পদ্ধতি।
কিছু দিন আগে ক্লিনিকে এসেছিলেন বছর চল্লিশের কল্পনা হালদার। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা সরকারি চাকুরে কল্পনা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। ঘটনাচক্রে বিয়ে করেননি। অথচ নিজের সন্তান চান। কল্পনার শরীর থেকে ডিম্বাণু বের করে সেই ডিম্বাণুকে দাতা শুক্রাণুর সাহায্যে শরীরের বাইরে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। পরে ভ্রূণটিকে রোপণ করা হয় কল্পনার শরীরে। তিনি এখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট।
বন্ধুর পথ
তবে ব্যাপারটা অনেক সময়ই সহজ হয় না। দাতা শুক্রাণুর সাহায্য নিলেই যে সঙ্গে সঙ্গে প্রেগন্যান্সি চলে আসবে, তা নয়। কারও এক বারেই প্রেগন্যান্সি আসতে পারে। কেউ বা বার কয়েক চেষ্টার পর তবে মাতৃত্বের স্বাদ পান। আসলে স্বাভাবিক ভাবে মাতৃত্বের ক্ষেত্রে যে ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে, এ ক্ষেত্রেও তাই রয়েছে। প্রেগন্যান্সি এলেও মিসক্যারেজ হতে পারে। তবে এ সব পেরিয়েও অনেকে মা হয়েছেন।
অনেক সময় এ সবের সঙ্গে উপরিপাওনা হিসেবে থাকে নানা রকম মানসিক টানাপড়েন। আসলে বিজ্ঞান এগিয়ে এলেও সমাজ এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নেয় না অনেক সময়। কখনও বা বাধাটা আসে পরিবার থেকে। একা একা মা! লোকে কী বলবে? তাই এই রাস্তা বেছে নিলেও অনেকের চলার পথ মসৃণ হয় না। কেউ বা দুই পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে আসেন। যাঁরা শেষমেশ সাহস করে এগিয়ে যান, তাঁদের অনেকে ব্যাপারটাকেই রাখতে চান লোকসমাজের আড়ালে। সব মিলিয়ে জোরদার লড়াই।
তবে সবাইকে যে এমনটা করতে হয়, তা নয়। যেমন তৃণা মুখোপাধ্যায়ের কথাই ধরা যাক। বিদেশে বহু দিন পড়াশুনো আর গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকায় ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার ফুরসত পাননি। বাকি জীবনটা কি এ ভাবেই একা একা চলবে? বাড়ি থেকে প্রবল চাপ। বিদেশে থাকার জন্য তৃণা জানতেন মা হওয়ার কৃত্রিম পদ্ধতি সম্বন্ধে। তাই এক ফাঁকে সময় বের করে তৃণা বাবার সঙ্গে চলে আসেন ক্লিনিকে। জমা রাখেন তাঁর ডিম্বাণু। এ ক্ষেত্রে তৃণা পাশে পেয়েছিলেন পরিবারকে।
এই মুহূর্তে বিয়ের পরিকল্পনা না থাকলে বা সঙ্গী খুঁজে পেতে দেরি হলে আগে ভাগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। পরে সময় মতো সেই ডিম্বাণুকে সঙ্গীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরি করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আলাদা করে আর ডিম্বাণুর দরকার পড়বে না। যেমনটা করেছেন তৃণা। আর যদি সঙ্গী না-ও পান, সাহায্য নিতে পারেন কোনও ‘ভিকি ডোনার’এর।
ম্যাচিং করে নেওয়া
তবে অচেনা কোনও ব্যক্তির শুক্রাণুর সাহায্য নিতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করেন। কারণ বাবা-মায়ের অনেক গুণ জিনের বাহিত হয়ে সন্তানের মধ্যে আসে। তাই এ ব্যাপারে অস্বস্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। সাধারণ ভাবে যাঁর শুক্রাণু ব্যবহার করা হচ্ছে, তাঁর পরিচয় গোপন রাখা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে শুক্রাণু ম্যাচ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও ক্লিনিকগুলোর। অর্থাৎ যিনি শুক্রাণু দিচ্ছেন, তাঁর চেহারা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বুদ্ধি, পারিবারিক পরিচয় হবু মায়ের চাহিদামতো ক্লিনিকগুলো যতটা সম্ভব ম্যাচ করিয়ে দেয়।
রাখতে পারেন ভ্রূণও
বছর চল্লিশের সুতপা আর সম্রাট আগের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছেন। কিন্তু আগের সম্পর্কে ডিভোর্স পাচ্ছেন না। এ দিকে বয়সও তো থেমে নেই। নতুন জীবন শুরু করতে যদি অনেকটা দেরি হয়ে যায়, সেই ভেবেই ক্লিনিকে এসে নিজেদের ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণটিকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। আইনসম্মত ভাবে বিয়ের অধিকার পেলে সন্তানের কথা ভাববেন তাঁরা। তারই প্রস্তুতি!
সত্যিই ভাবা যায় না। ভবিষ্যতের জন্য ভ্রূণকেও সংরক্ষিত করা হচ্ছে। পরে সন্তান চাইলে ভ্রূণটিকে গর্ভে রোপণ করা যাবে। এই ভাবে পাঁচ বছর পর্যন্ত ভ্রূণকে সংরক্ষণ করা যায়। আসলে বিজ্ঞান অনেক রকম উপায় মেলে রেখেছে সামনে। প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করাই আসল কথা।
যোগাযোগ-৯৮৩০৬৬৬৬০৬
সাক্ষাৎকার: রুমি গঙ্গোপাধ্যায়