গত ১৫ নভেম্বর জ্ঞান মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় দর্পণী প্রযোজিত ‘সৃজনোৎসব ২০২৪’। সৃজনোৎসবের এটি তৃতীয় বর্ষ। ওড়িশি, ভরতনাট্যম এবং কত্থক এই তিন ঘরানার ধ্রুপদী নৃত্য দিয়ে সাজানো ছিল এই বছরের সৃজনোৎসব। উৎসবের সূচনা করেন গুরু অরুন্ধতী রায় এবং গুরু সুজাতা রামলিঙ্গম। দর্পণীর কর্ণধার অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরীয় পরিয়ে তাঁদের বরণ করে নেন।
প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ‘ওড়িশি’। পরিবেশনায় দর্পণী এবং পরিচালনা ও কোরিয়োগ্রাফিতে ছিলেন অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম নিবেদন জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রথম শ্লোক ‘শ্রীত কমলা’। এই শ্লোকটি পরিবেশনে দর্পণীর ছাত্রছাত্রীদের অভিনয় মনে রাখার মতো। এই শ্লোকটির সঙ্গীত রচনা করেছেন পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্র। দ্বিতীয় নিবেদন লোকগাথা ‘দেখ গো সখী’। এই নৃত্যাংশেও ছাত্রছাত্রীদের সম্মেলক নৃত্য দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দর্পণীর শেষ নিবেদন, জয়দেবের গীতগোবিন্দের ‘তুভ্যম নমহ’, যেখানে কৃষ্ণের দশাবতারের বর্ণনা করা হয়েছে। কৃষ্ণরূপী অর্ণব তাঁর সুন্দর নৃত্যভঙ্গিমার সঙ্গে নিখুঁত হস্তমুদ্রা প্রয়োগ করেছেন। ছাত্রছাত্রীরাও মীন, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি এই দশাবতারের ‘মুদ্রা’ প্রদর্শনে প্রত্যেকেই যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নরসিংহ, বামন এবং কল্কি অবতারের দৃশ্যে শিল্পীদের পল্লবী এবং অভিনয় মনে রাখার মতো। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর নৃত্যে দক্ষ অনুশীলনের ছাপ সুস্পষ্ট। এঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য অনুস্মিতা ভট্টাচার্য, নিকিতা দাস এবং রামরূপী সোহম দে। এই নৃত্যাংশের সঙ্গীত রচয়িতা হিমাংশু সোরেন এবং নৃত্য নির্দেশনা ও পরিকল্পনা অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দর্পণীর পোশাক ও আলোর ব্যবহার বেশ উজ্জ্বল।
সৃজনোৎসবের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান ‘ভরতনাট্যম’। পরিবেশনায় শুভজিৎ দত্ত, করুণাকেতন ভক্ত এবং সায়ন সরকার। এই ত্রয়ী শিল্পীর প্রথম নিবেদন ‘স্বরাঞ্জলি’। ‘স্বর’ অর্থাৎ সুর এবং ‘অঞ্জলি’ অর্থাৎ ভক্তিভরে অর্পণ। ভরতনাট্যমের এই বিশেষ নৃত্যটিতে সঙ্গীতের মূর্ছনা এবং তান, লয় ও ছন্দের ব্যঞ্জনাকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ত্রয়ী শিল্পী। রাগ মালিকা এবং আদি তালে নিবদ্ধ ‘স্বরাঞ্জলি’র কোরিয়োগ্রাফি করেছেন গুরু সুজাতা রামলিঙ্গম। ত্রয়ী শিল্পীর দ্বিতীয় নিবেদন ‘ইল্লাই ইল্লা ইনবুম’। এই নৃত্যাংশ একটি কীর্তনম, যেখানে শিবের ‘আনন্দতাণ্ডব’ অর্থাৎ নটরাজের সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ— এই তিন রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। সাবলীল বলিষ্ঠ দেহভঙ্গিমা ও অভিনয়ের মাধ্যমে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছেন এই তাণ্ডবলীলার দৃশ্যগুলিকে। এই নৃত্যটি আদি তাল ও অমৃতবর্ষিণী রাগে নিবদ্ধ। সঙ্গীত রচয়িতা মাদুরাই আর মুরলীধরন। নৃত্য পরিকল্পনায় গুরু সুজাতা রামলিঙ্গম। এই পর্বের শেষ নিবেদন ছিল ‘তিলানা’। এই নৃত্যাংশেও শিল্পীদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাগ ‘বিলাহরি’ ও আদি তালে নিবদ্ধ তিলানাটির কোরিয়োগ্রাফি রুক্মিণী দেবী অরুন্ডালের। ভরতনাট্যমের ত্রয়ী শিল্পীর মুদ্রা ব্যবহারও অত্যন্ত নিখুঁত। তবে পোশাকের জৌলুস কম ছিল।
এর পর ওড়িশি নাচের ডালি নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হলেন ত্রয়ী শিল্পী সায়মিতা দাশগুপ্ত, সংযুক্তা রায় ঘোষাল এবং রাজনীতা মেহরা। প্রথম নিবেদন কিরওয়ানি রাগে নিবদ্ধ ‘পল্লবী’। এই নৃত্যাংশে সায়মিতার নৃত্যভঙ্গিমা, ভাব এবং মুদ্রার ব্যবহার দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অপর দুই শিল্পীর আরও অনুশীলন এবং তালিমের প্রয়োজন। পরবর্তী নিবেদন ‘দুর্গাস্তুতি’, যেখানে দুর্গার বিভিন্ন রূপকে তুলে ধরা হয়েছে অভিনয়ের মাধ্যমে। এই নৃত্যাংশে মহিষাসুর বধের দৃশ্যটি চমৎকার।
ওই দিনের শেষ উপস্থাপনা সৌরভ রায়, শৌভিক চক্রবর্তী এবং সুব্রত পণ্ডিত পরিবেশিত কত্থক নৃত্য। এই ত্রয়ী শিল্পীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন তবলায় বিশ্বজিৎ পাল, সরোদবাদনে সুনন্দ রায়, এবং বোল বলেছেন রাজীব ঘোষ। শুরুতে বারো মাত্রার চৌতালে শিল্পীরা তাঁদের নৃত্য প্রদর্শন করেন। নাচের মধ্যেই মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বোল বলা এবং নৃত্য পরিবেশন করা কত্থক নাচের একটি রীতি। এই রীতির যথাযথ সদ্ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। চৌতালে নিবদ্ধ ‘বন্ধু’ পর্বে যৌথ ভাবে শিল্পীদের পরিবেশনা ভাল লাগে। ‘বাঁশি’, ‘তলোয়ার’ প্রভৃতি একক পরিবেশনায় শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষ। ‘বাঁশি’ নৃত্যে বালক কৃষ্ণ, যুবক কৃষ্ণ এবং রাজনীতিক কৃষ্ণের রূপকে মঞ্চে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে, সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সৌরভ। পরিশেষে পরিবেশিত হয় ‘যুগলবন্দি’, যেখানে নৃত্য ও তবলার মেলবন্ধন ছিল উপভোগ্য।
একটি মনোরম সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল দর্পণী, যার সহায়তায় ছিল সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি। এই রকম দৃষ্টিনন্দন অনুষ্ঠান ভবিষ্যতে আরও হোক, আশা রাখব।
অনুষ্ঠান