প্রতীকী ছবি।
২০১৫ গ্রীষ্ম। বাড়িতে দিদির দেহ আগলে বসেছিলেন ভাই। তা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা শহর।
রবিনসন স্ট্রিট কাণ্ডের কথাই হচ্ছে। সে মৃত্যু ‘কাণ্ড’ হয়ে পরিচিত হয়েছিল মুখে মুখে। দিদি দেবযানী দে না হয় চলে গেলেন। সেই ভাই, পার্থ দে পড়েছিলেন নানা বিশ্লেষণের মুখে। সে বাড়ি দেখতে ভিড় জমত দিনের পর দিন। মানসিক হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়া পাওয়ার পরও পার্থকে দেখতে জমত মিছিল। কিন্তু এ ঘটনা কি এতই বিরল? নদিয়ার ধুবুলিয়ায় এক মায়ের দেহ পাঁচ মাস পর উদ্ধার হয়েছে। দেহ পরিণত হয়েছিল কঙ্কালে। সেই কঙ্কাল আগলে বসেছিলেন মৃতার মাঝবয়সি কন্যা। এই ঘটনা আবার মনে করায়, এমনটা তো হয়েই থাকে। এ বিরল নয়। রবিনসন স্ট্রিটের পর একই ধরনের ঘটনা কখনও দেখা গিয়েছে সল্টলেকে। কখনও বা অন্য কোথাও। সে বারের মতো সাড়া ফেলেনি হয়তো। কারণ কলকাতা তত দিনে জেনেছে, এমনও হয়।
ধুবুলিয়ার ঘটনা প্রশ্ন তুলছে বারবার কেন এমন হয়? কেন প্রিয়জনের দেহ আগলে বসে থাকেন কেউ?
এক কথায় বলে দেওয়া খুব সহজ। দেগে দেওয়া যায় তাঁকে মানসিক রোগী বলে। কিন্তু এ কেমন রোগ? কেন এমনটা হয়?
সম্প্রতি নদিয়ার ধুবুলিয়া থানার বাজার কলোনি পাড়ায় এক বাড়িতে গিয়ে পুলিশ দেখেছে, ঘর অন্ধকার। দরজা-জানলা এঁটে বন্ধ করা। সুন্দর করে গোছানো বিছানার উপর পড়ে রয়েছে নরকঙ্কাল। পাশে যত্নে রাখা আছে দুধের গ্লাস। কঙ্কালটি মায়ের। ঘরেই রয়েছেন তাঁর মেয়ে। পুলিশকে জানিয়েছেন, মা দুধ খাচ্ছেন। মেয়ের তাতেই শান্তি।
তা দেখেই সকলের মনে হয় এ ঘটনায় রবিনসন স্ট্রিটের ছায়া রয়েছে। পার্থ দে-র জায়গা নিয়েছেন মৃতা মন্দিরা দাসের বছর আটত্রিশের মেয়ে দোলা দাস। কিন্তু কেন এমন হল, তা ভাবতে গিয়েই খেতে হয় হোঁচট। বারবার ফিরে আসা পরিস্থিতি তো বিরল হয় না। রবিনসন স্ট্রিটের ঘটনা বিরল বলে দেগে দিয়ে সমস্যা কত দূর গড়িয়েছিল তা কারও অজানা নয়। পার্থ আর কখনও বাঁচার সুযোগ পাননি। এত জোড়া চোখ তাঁর জীবনের বাকি ক’টা দিন নজরে রেখেছিল পার্থকে, তা নিয়ে চলা সহজ ছিল না। দোলার জীবন কি কিছুটা এগোবে? খানিকটা অন্য রকম হবে?
প্রতীকী ছবি।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিতে বলছেন সে দিকে। বলছেন, ‘‘দেখতে হবে যেন ‘মানসিক রোগী’, ‘কঙ্কালের মেয়ে’, ‘পাগল’— এমন সব নামে দেগে না দেওয়া হয় দোলাকে। বোঝাই যাচ্ছে তিনি যথেষ্ট একাকিত্বে ভুগেছেন। হয়তো সে কারণেই আগলে রাখতে চেয়েছিলেন নিজের মায়ের দেহ। মা-ই হয়তো ছিলেন তাঁর একমাত্র নির্ভর করার মতো মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে আর যাতে নতুন করে আঘাত করা না হয়, সে দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, এই ভুলটা পার্থ দে-র ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আর পার্থর অকালমৃত্যু দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁর প্রতি বড় অন্যায় হয়েছে।’’
কিন্তু এমন ঘটনা কেন ঘটছে বারবার? কী থাকতে পারে এর পিছনে? এ সব প্রশ্নও যে ওঠে। অনুত্তমা বলছেন, ‘‘যে সকল মানুষ এ ভাবে আগলে রাখছেন মৃত আত্মীয়ের দেহ, হতে পারে তাঁর আর কেউ নেই। এ ক্ষেত্রে যেমন ঘটনাটি শুনে মনে হচ্ছে সম্ভবত বাইরের জগতের সঙ্গে খুব কম যোগাযোগ রয়েছে দোলার। ঠিক যেমন প্রায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকত না রবিনসন স্ট্রিটের পার্থর এবং তাঁর বোনেরও। যখন এক জন মানুষই আমার পৃথিবী হয়ে যান, তখন সেই মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে তাঁর দেহ আগলে রাখার, তাঁর অবশিষ্ট উপস্থিতি ধরে রাখার চেষ্টা আমরা অনেক সময়ে দেখতে পাই। কারণ শেষকৃত্য করে ফেললে তো সেই মানুষটির আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে তাঁর দেহ আগলে রাখার প্রচেষ্টা কিন্তু শোকেরই একটা মুখ।’’ হয়তো নিকট জনের মৃত্যু, তাঁর চলে যাওয়া কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না আর এক জন। তাঁকে কোনও ভাবে রাখতে চাইছেন। এ কিন্তু তেমনই প্রয়াস।
দেহ আগলে রাখা হয়তো প্রতিনিয়ত ঘটছে, এমন নয়। তাই তা ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হয় না। কিন্তু মন থেকে প্রিয়জনকে আগলে রাখার ইচ্ছা বিভিন্ন সমাজে নানা ভাবেই দেখা গিয়েছে বলে মনে করান অনুত্তমা। মিশরের মমি রাখার প্রচলন হোক, কিংবা এ দেশে মৃত আত্মীয়ের উদ্দেশে কোনও খাবার রাখা হোক— এও তো ধরে রাখারই ইচ্ছার প্রকাশ। প্রিয়জনকে অনেকেই ছাড়তে পারেন না। দোলা কিংবা পার্থর ঘটনা তারই আর এক রূপ।