দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই চোখ ছানাবড়া পুলিশের। প্রতীকী ছবি।
সুন্দর করে গোছানো ঘরের বিছানা। উপরে কতগুলি হাড়ের টুকরো। ক্ষয়ে গেলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আস্ত নরকঙ্কাল ওটা। আর পাশেই রাখা দুধের গ্লাস। দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই চোখ ছানাবড়া পুলিশের। তত ক্ষণে বিকট গন্ধ আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিছানার পাশে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়সি মহিলা। স্তম্ভিত পুলিশ অফিসার নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনার মা কোথায়?’’
মহিলার জবাব, ‘‘মা? ওই তো দুধ খাচ্ছে...।’’
কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের ছায়া এ বার দেখা গেল নদিয়ার ধুবুলিয়া থানার বাজার কলোনি পাড়ায়। পুলিশ সূত্রে খবর, পাঁচ মাস ধরে এ ভাবেই মা মন্দিরা দাসের দেহ আগলে বাড়িতে থাকেন বছর আটত্রিশের দোলা দাস। মন্দিরাকে দীর্ঘ দিন দেখতে না পেয়ে এবং দোলার থেকে মায়ের ব্যাপারে স্পষ্ট উত্তর না পেয়েই পুলিশে খবর দিয়েছিলেন প্রতিবেশীরা।
স্থানীয়দের সূত্রে খবর, স্ত্রী ও মেয়েকে ছেড়ে অনেক বছর আগেই নিরুদ্ধেশ হয়ে গিয়েছিলেন স্বামী। সেই শোক সামলাতে পারেননি মন্দিরা। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন তিনি। মায়ের অসুস্থতার কারণে নিজে অবিবাহিত থেকেছেন দোলা। দু’টি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন তিনি। এ ভাবেই সংসার চলে। মায়ের কঙ্কাল শোয়ানো থাকে বিছানায়। দোলাকে জিজ্ঞেস করে পুলিশ জানতে পারে, বাইরের বারান্দায় তিনটি চেয়ার পাশাপাশি জুড়ে রাতে ঘুমোন তিনি।
মন্দিরাকে দেখতে না পেয়েই সন্দেহ দানা বাঁধে প্রতিবেশীদের মনে। প্রশ্ন করলে অসংলগ্ন জবাব দিতেন দোলা। প্রতিবেশী মানসী বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা জিজ্ঞাসা করলেই দোলা বলত, মা কলকাতা গিয়েছে। ক’দিন পর ফিরবে।’’
কিন্তু পাঁচ মাস ধরে মন্দিরার দেহ যে বাড়িতেই রয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কেউ। যদিও দোলার বাড়ির খুব কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই। গন্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দরজা-জানলাও ‘এয়ার লক্ড’ করা। পুলিশ সূত্রে খবর, ঘর থেকে পচা খাবার, বাসন আর কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গিয়েছে। মন্দিরার মৃত্যু যে পাঁচ মাস আগে হয়েছিল, তা তাঁর দেহের প্রাথমিক পরীক্ষার পর নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, মায়ের মৃত্যু নিয়েই আপাতত দোলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রঞ্জন ভট্টাচার্য এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘‘অনেক সময় মানসিক অসুস্থতা, অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতাই এমন আচরণের জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে বিয়ে না-হওয়াও বড় কারণ হতে পারে। তবে স্কিজোফ্রেনিয়ার আশঙ্কাই সব চেয়ে বেশি। ছোট বেলায় বাবাকে হারানো আর বড়ো হয়ে মায়ের মানসিক রোগ দোলার উপর প্রভাব ফেলেছে।’’