মূল দেওয়াল ঘড়ি এবং লেডিকেনি হাতঘড়ি। ছবি: অরিত্র মুখোপাধ্যায়
মধ্য কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তার পাশে শহরের নামী মিষ্টির দোকান। তার দেওয়ালে টিক টিক করে সময় দিয়ে চলেছে এক গোলাকার ঘড়ি। কালো আবলুশি কেসের মধ্যের আইভরি রঙের ডায়াল। তাতে সময়ের চিহ্নক সংখ্যাগুলো সবই বাংলা অক্ষরে লেখা। বাংলা সংখ্যায় নয়, বাংলা অক্ষরে। অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪-এর বদলে এক, দুই, তিন, চার। সব ক’টা শব্দই কালো রঙে। কেবল ‘বারো’ শব্দটা লেখা লাল রঙে। ডায়ালের মাঝখানে ঘড়ির নির্মাতার নাম। তার নীচে লেখা ‘লন্ডন’। সবই বাংলা হরফে।
কলকাতার সেই প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকানের সন্দেশের মতোই এই ঘড়ির খ্যাতিও জমকালো। দোকানে গিয়ে এই ঘড়িটির দিকে চোখ পড়েনি, এমন লোক বিরল। এই ঘড়ির ইতিহাসও বেশ পরিচিত এক নাগরিক কিংবদন্তি। সন ১৮৫৮। মহাবিদ্রোহের আগুন তখন নিভে এসেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশরাজের হাতে যাব যাব করছে। ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে আসীন লর্ড ক্যানিং। কথিত, স্ত্রী লেডি শার্লট ক্যানিংয়ের জন্মদিনের পার্টিতে অভ্যাগতদের চমক দিতেই লর্ড ক্যানিং ওই মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীকে এক অভিনব মিষ্টি তৈরির বরাত দেন। তারই ফল হিসেবে তৈরি হয় এক অভিনব মিষ্টি। যার নামকরণ করা হয় লেডি ক্যানিংয়ের নামানুসারেই। কালক্রমে ভারতীয় উচ্চারণে তা হয়ে দাঁড়ায় ‘লেডিকেনি’।
লেডি শার্লট ক্যানিং (১৮১৭-১৮৬১)। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৮৫৮ সালের সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নাকি নিমন্ত্রিত ছিলেন শহরে সদ্য আগত দুই বিখ্যাত ঘড়িনির্মাতা। নতুন ‘ডেজার্ট’-এর প্রেমে পড়ে যান দুই ‘ঘড়ি সাহেব’। এবং ঠিক করেন, ওই মিষ্টি প্রস্তুতকারী সংস্থাকে তাঁরা একটি দেওয়াল ঘড়ি উপহার দেবেন। সাহেব কোম্পানির উপহার বলে কথা! মিষ্টান্ন নির্মাতারা খুশি। কিন্তু মুশকিল হল এক জায়গায়। দোকানের কর্মচারীরা কেউ ইংরেজি বা রোমান হরফের সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত নন। তাঁরা অনুরোধ করলেন, যদি ঘড়ির সময়সূচক সংখ্যাগুলি বাংলায় লিখে দেওয়া যায়। দুই সাহেব তাঁদের অনুরোধেই নাকি এক থেকে বারো বাংলা হরফে লিখে দেন ঘড়ির ডায়ালে। সেই সঙ্গে নিজেদের কোম্পানি আর নিজেদের বাসভূমির নামও বাংলা হরফেই লিখে দেন। এর পিছনে যে সেই ঘড়ি নির্মাতা সংস্থার এক ঘোরঘট্ট ব্যবসাবুদ্ধি কাজ করেছিল, সে কথাও মনে রাখতে হবে। শহরের অন্যতম প্রধান মিষ্টান্ন বিপণির দেওয়ালে শোভা পাবে যে ঘড়ি, তার ডায়ালে বাংলা হরফে কোম্পানির নাম লেখা থাকলে অগণিত ক্রেতাও জানতে পারবেন শহরে নবাগত কোম্পানির নাম। বিজ্ঞাপনের দিক থেকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
লেডিকেনি ঘড়ি ও তার আনুষঙ্গিক পুস্তিকা। ছবি: অরিত্র মুখোপাধ্যায়
১৯৩০ সাল নাগাদ ঘড়ি তৈরি বন্ধ করে রুপোর গয়না আর অন্যান্য জিনিসের ব্যবসা চালু রাখে দুই সাহেবের সংস্থা। কিন্তু দেড়শো বছর পার করে অকালপ্রয়াতা লেডি ক্যানিংয়ের (মাত্র ৪৪ বছরেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি) স্মৃতি তার স্প্রিং আর কাঁটায় ধারণ করে এখনও দিব্যি সময় দিচ্ছে সেই ঘড়ি। এমন এক জলজ্যান্ত ‘বাংলা’ স্মৃতিকে কি দেওয়াল থেকে নামিয়ে আনা যায় কব্জিতে? বাঙালির হাতে ধরা থাকবে ‘বাংলা’ সময়? এমন ভাবনাই তাড়া করছিল অরিত্র, দেবদীপ, ক্ষিতিজকে। তাঁরা ঘড়ি-প্রেমিক, ঘড়ি-ভাবুকও বলা যেতে পারে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, একেবারেই ভালবাসা থেকে তিন বন্ধুর একটি দল, যার পরিচয় তাঁরা দেন ‘ইনজিনিয়াস বোফিনস’ বলে, হাতে তুলে নেন ‘প্রজেক্ট লেডিকেনি’। লেডি শার্লট ক্যানিং, তাঁর নামাঙ্কিত মিষ্টি, মিষ্টান্ন বিপণি— সব কিছু ধরা থাকবে একটা মুঠোয়।
শুরুতে ভাবনাটা তুলে ধরা হয় নেটমাধ্যমে। আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলে। একেবারেই অব্যবসায়িক বিন্দু থেকে শুরু হয় ‘লেডিকেনি হাতঘড়ি’ তৈরির কাজ। প্রথমেই ১০০টি ঘড়ির বরাত পান তাঁরা। স্থির করেন, আধুনিক প্রযুক্তির কোয়ার্ৎজ ঘড়ি নয়, দম দেওয়া মেকানিক্যাল ঘড়িই তৈরি করবেন। মুম্বইয়ের এক ঘড়িনির্মাতা আলি বাগাসরাওয়ালা এগিয়ে আসেন ‘লেডিকেনি হাতঘড়ি’-কে যান্ত্রিক রূপদানের কাজে। ঘড়ির নকশা করেন ক্ষিতিজ। বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের সেই দেওয়াল ঘড়ির আদলেই যে হাতঘড়িতে বাংলা হরফে লেখা থাকছে এক থেকে বারো। সব শব্দ কালো রঙে লেখা হলেও ‘বারো’ লেখা থাকছে লালেই। দেওয়াল ঘড়িটির ডায়ালের রঙেই হচ্ছে লেডিকেনি ঘড়ির ডায়াল। সেখানে লেখা থাকছে ‘লেডিকেনি’ আর ‘ভারত’।
লেডিকেনি ঘড়ি, সামনের ও পিছনের চেহারা। ছবি: অরিত্র মুখোপাধ্যায়
উৎসাহী ক্রেতাদের জানানো হয়েছিল, হাতঘড়ির সঙ্গে থাকবে চামড়ায় তৈরি ঘড়ির কেস। সেখানে চামড়ার স্ট্র্যাপ-সহ ঘড়ির সঙ্গে থাকবে অতিরিক্ত একটি স্ট্র্যাপ এবং একটি পুস্তিকা। যার মলাটে আঁকা কলকাতার একটি ‘ডুডল’। মলাট ওল্টালে সেই দেওয়াল ঘড়ি, লেডিকেনি, শার্লট ক্যানিং আর লেডিকেনি হাতঘড়ি তৈরির ইতিবৃত্ত। মলাটের নকশা আপ্যায়ন মণ্ডলের। লেডিকেনি হাতঘড়ি পাওয়া যাবে রুপোলি আর কালো রঙে। ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা কালো। সেকেন্ডের কাঁটা লাল। ঘড়ির পিছনদিক স্বচ্ছ। যাতে যান্ত্রিক চলন বোঝা যায়। পিছনের ধাতব অংশে বাংলায় লেখা থাকছে ছড়া— ‘মিষ্টি মুখে কোলাকুলি/ ফুটবে হাসি মিটি মিটি’। এই ‘মিটি মিটি’-তেই যেন ধরা থাকছে মেকানিক্যাল ঘড়ির টিক টিক। দেবদীপ আর অরিত্র জানাচ্ছেন, এটাই তাঁদের প্রথম প্রকল্প। জানালেন, ঘড়ির রূপদানে আলি বাগসরাওয়ালা এক পয়সাও পারিশ্রমিক নেননি। ঘড়ির স্ট্র্যাপের রূপদান করেছেন দিব্যা গোয়েল। নির্মাণে সহায়তা করেছেন বিক্রম নারুলা। নকশা করেছেন ক্ষিতিজ। প্রথম ১০০টি লেডিকেনি ঘড়ি পৌঁছে গিয়েছে বরাতদাতাদের হাতে। আবার ১০০টির বরাত পেলে হাতে নেবেন দ্বিতীয় কিস্তির কাজ। ঘড়ির নাম ‘লেডিকেনি’ রাখতে প্রায় একমাস লেগেছে ভাবনা-চিন্তায়।