ট্যাক্সি মালিকেরাই মানছেন, বাজারে ওলা, উবর আসার পরে যাত্রীদের কাছে ট্যাক্সির চাহিদা অনেক কমেছে। ছবি: সংগৃহীত।
দাদা, মধ্যমগ্রাম যাবেন?
—যেতে পারি। ৫০০ টাকা লাগবে।
—কেন? মিটারে তো বড়জোর ৩০০ টাকা ওঠে।
—ওখান থেকে প্যাসেঞ্জার পাব না! খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে।
বেশি টাকা দিতে রাজি না হতেই হুশ করে হাওয়া হয়ে গেল হলুদ রঙের ট্যাক্সিটা। অথচ গায়ে নীল রং দিয়ে বড় বড় করে লেখা ‘নো রিফিউজাল’।
শহর জুড়ে হলুদ ট্যাক্সির প্রত্যাখ্যানের এমন ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। শহর থেকে শহরতলি— গন্তব্য যা-ই হোক, অধিকাংশ ট্যাক্সিচালকই বেশি টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ যাত্রীদের। গাঁটের অতিরিক্ত কড়ি খরচ না করলে ট্যাক্সি মেলাই ভার। দিন দিন শহরে কমে যাচ্ছে ট্যাক্সির সংখ্যা। রাজ্যের পরিবহন দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতার রাস্তায় এখন মোটে সাত হাজারটি ট্যাক্সি চলছে। কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার আগে এই সংখ্যাটা ছিল আঠারো হাজারের কাছাকাছি। একটা সময় শহরে ছিল হলুদ ট্যাক্সির দৌরাত্ম্য। শহরের নানা প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াত হলুদ ট্যাক্সি। তবে এখন সেই দৌরাত্ম্যে ভাটা পড়েছে।
কলকাতা মানেই রসগোল্লা, ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা, হাতে টানা রিকশা আর হলুদ ট্যাক্সি! ১৯৬২ সালে শহরে শুরু হয় হলুদ ট্যাক্সির যাত্রা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ট্যাক্সিই হয়ে উঠল শহরের অন্যতম ‘আইকন’। তবে শহরের ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে। কেন হল এমন পরিস্থিতি? এআইটিসি অনুমোদিত ট্যাক্সি চালকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যাক্সি অপারেটার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা নওলকিশোর শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘প্রতিদিন হলুদ ট্যাক্সি কমে যাওয়ার কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়। ২০১৮ সালে শেষ বার হলুদ ট্যাক্সির ভাড়া বেড়েছিল, তার পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। করোনা সংক্রমণের ধাক্কার পর সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু সরকার অনুমতি না দেওয়া হলুদ ট্যাক্সির ভাড়া বাড়েনি। পাশাপাশি, ১৫ বছর বয়সের যে সব ট্যাক্সি বাতিল হয়েছে, তাদের বিকল্প হিসেবে নতুন গাড়ির পারমিট দেওয়ার কথা পরিবহণ দফতরের। কিন্তু সেই পারমিটও দেওয়া হচ্ছে না।’’
এই শহরের তরুণ প্রজন্ম এখন ট্যাক্সির দিকে ফিরেও তাকাতে পছন্দ করে না। ছবি: সংগৃহীত।
তবু ক্রমশ বাজার দখল করে নিচ্ছে এক ফোনে কাছে এসে দাঁড়ানো ওলা, উবর। ট্যাক্সি মালিকেরাই মানছেন, বাজারে ওলা, উবর আসার পরে যাত্রীদের কাছে ট্যাক্সির চাহিদা অনেক কমেছে। যার জেরে কমেছে রোজগার। পাল্লা দিয়ে তাই নতুন ট্যাক্সি বার করার আগ্রহও কমছে। ক্যালকাটা ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অরুণ সিংহ বলেন, ‘‘হলুদ ট্যাক্সি যে দিন দিন কমে যাবে বা যাচ্ছে তা-ই নয়, ২০২৪ সালের মধ্যে এই ট্যাক্সি পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, পরিবহণ দফতর ট্যাক্সিচালকদের কথা শুনতে আগ্রহী নয়। আমাদের ভাড়া ছাড়াও আরও কিছু দাবিদাওয়া রয়েছে। সে কথা যদি সরকারপক্ষ না শোনে তা হলে কে শুনবে?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ওলা-উবরের দাপট এখন হলুদ ট্যাক্সির কারণেই একটু হলেও কম। যখন হলুদ ট্যাক্সি থাকবে না, তখন এদের প্রকৃত চেহারা সামনে আসবে। এখনই ওদের পরিষেবা সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু এ সব বিষয়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারপক্ষ সজাগ না হলে, আগামী দিনে উভয়কেই ভুগতে হবে।’’
এই শহরের তরুণ প্রজন্ম এখন ট্যাক্সির দিকে ফিরেও তাকাতে পছন্দ করে না। তাঁদের দাবি মুখের উপর বারে বারে না শুনতে কার ভাল লাগে বলুন তো? তা ছাড়া ওলা, উবরের মতো দুয়ারে পরিষেবাটাও তো ট্যাক্সির ক্ষেত্রে মেলে না! অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ট্যাক্সিচালকদের কোথাও যাওয়ার কথা বললেই মনে হয় যেন এক কালে তাঁদের প্রপিতামহ জমিদার ছিলেন। ভবানীপুর থেকে গড়িয়াহাট যাব শুনলেই তাঁরা বলে ওঠেন, দাদা বড্ড কাছে, যাব না! আবার যদি বলি ভবানীপুর থেকে ব্যারাকপুর যাব তখন শুনতে হয়, অনেকটা দূর হয়ে যাচ্ছে দাদা। বুঝতে পারি না, ওদের সমস্যাটা কোথায়! ওলা, উবরেও এখন একই রকম ভোগান্তি হয়। ফোন করেই আগে আটচল্লিশটা প্রশ্ন! কোথায় যাবেন? কত টাকা দেখাচ্ছে? অনলাইনে টাকা দেবেন না কি নগদ, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সব মিলিয়েই আখেরে ভোগান্তি হয় যাত্রীদেরই। শহরের হলুদ ট্যাক্সি এখন অনেক কমে গিয়েছে, বিষয়টা সত্যিই খুব দুঃখের। ওলা, উবরের দৌরাত্ম্যই এর জন্য দায়ী।’’