সন্তান তো জীবনবিমা নয়, যে বয়স হলে সে দেখবে বলেই তাকে পৃথিবীতে আনতে হবে। গ্রাফিক্স: সনৎ সিংহ
মা হওয়া মুখের কথা নয়। একটি ফুটফুটে প্রাণকে পৃথিবীর আলো দেখালেই মায়ের ভূমিকা শেষ হয়ে যায় না। বরং যুদ্ধটা শুরু হয় এর পর থেকে। কিন্তু অনেকেই এই যুদ্ধে নামার জন্য মানসিক, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকেন না। কিংবা কেউ হয়তো মাতৃত্বই চান না। অথচ বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিবার পরিজনদের গলায় শুনতে পাওয়া যায় প্রত্যাশার সুর। এই একুশ শতকেও বা়ড়ির সামনে ফেলে যাওয়া হয় কার্তিক ঠাকুর। বলা বাহুল্য গোটা বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই বিষয়টির অনেক আঙ্গিক আছে। এর সঙ্গে অনেক আবেগ যেমন জড়িত থাকে তেমনই জুড়ে থাকে যন্ত্রণাও। অনেক প্রত্যাশা, না পাওয়া, প্রিয়জনের সঙ্গে সঙ্ঘাত জড়িয়ে থাকে একই সুতোয়।
বিবাহ পরবর্তী জীবনে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার দাবি সঙ্গীর কাছ থেকে যত না, তার চেয়েও অনেক বেশি আসে পরিবারের কাছ থেকে। সন্তান না হলে চারপাশের লোকজন কী বলবে! লোকের ভয়ে সন্তান ধারণের এই ক্রমাগত মানসিক চাপ নিয়েই রবিবার আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক ও ইউটিউবে আলোচনায় বসলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘লোকে কী বলবে ! সঙ্গে অনুত্তমা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের এটি ছিল ষষ্ঠ পর্ব। এ পর্বের বিষয় ‘সন্তান চাও না!’
মা হওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পারিপার্শ্বিক থেকে নানা চাপ আসতে থাকে। তেমনই কিছু অভিজ্ঞতার কথা উঠে এল রবিবারের আলোচনায়। প্রতি পর্বের আগেই অনুত্তমার কাছে পাঠানো যাবে প্রশ্ন। এ পর্বেও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ই-মেলে তেমনই কিছু প্রশ্ন পেয়েছিলেন মনোবিদ।
পৌলমী জানিয়েছেন, তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা। পুষ্টিবিদ হিসাবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও জড়িত। বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই ক্রমাগত কবে মা হবেন সেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে। এ বছরের জন্মদিনেও সকলের শুভেচ্ছা বার্তার মধ্যেও মিশে ছিল দ্রুত মা হওয়ার কামনা। এমনকি কর্মক্ষেত্রে গিয়েও তাঁকে পড়তে হচ্ছে একই প্রশ্নের মুখে। পৌলমী মা হতে চান না এমন নয়। তবে এখনই নয়। মানসিক ভাবে তিনি এখনও ঠিক তৈরি নন। এ অভিজ্ঞতার গা ঘেঁষে উঠে এসেছে আরও একটি প্রশ্ন।
শ্রমণা জানিয়েছেন, তাঁর বিয়ে হয়েছে এক বছর। ছোট থেকেই নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তিনি ভীষণই স্পষ্ট। স্বামীর সঙ্গে যৌথ আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাঁরা সন্তান চান না। কিন্তু বাড়ির অভিভাবকেরা সে সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানতে চাইছেন না। তাঁদের দাবি, বয়স হলে কে দেখবে? মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, অভিভাবকত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার তাগিদ ভিতর থেকে আসা প্রয়োজন। নিজে থেকে মা হতে চাওয়ার মধ্যে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সন্তান তো জীবনবিমা নয়, যে বয়স হলে সে দেখবে বলেই তাকে পৃথিবীতে আনতে হবে। পারিপার্শ্বিক থেকে আসা প্রত্যাশা যেন মা হওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে না ওঠে সে কথা বোঝালেন মনোবিদ অনুত্তমা।
এ তো গেল পরিজন, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে আসা প্রত্যাশার কথা। কিন্তু এ তাগিদ যদি সরাসরি আসে প্রিয়জনের কাছ থেকে, তখন লড়াইটা একটু কঠিন হয়ে যায় না কি? প্রচেতা জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী দেশের বাইরে থাকেন। তিনি মা হতে চান না। কিন্তু পাশের মানুষটি প্রবল ভাবে বাবা হতে চাইছেন। অনেক দিন দেখা হয়নি দু’জনের। তবু ভিসার আবেদন করতে তাঁর কোথাও যেন একটা আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ দেখা হলেই তো এই বিষয়টি উঠবে। কী ভাবে স্বামীকে বোঝাবেন তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না প্রচেতা। সমস্যা এড়িয়ে গেলে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলির মোকাবিলা মুখোমুখি করাটাই বাঞ্ছনীয়। প্রচেতাকে তাই ভিসার আবেদন করে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন অনুত্তমা। দু’জনে সামনা সামনি বসে কথা বললে একটা সমাধানসূত্র ঠিকই বেরিয়ে আসবে। সে আশ্বাসও দিলেন তিনি।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিয়ের কয়েক বছর পরেও সন্তান না হওয়ার দায় চাপানো হচ্ছে মেয়েটির উপরে। ধরে নেওয়া হচ্ছে মেয়েটির বোধহয় কোনও শারীরিক অক্ষমতা রয়েছে। এমন সমস্যার অনুরণন পাওয়া গেল লতিকার প্রশ্নে। লতিকা জানিয়েছেন, সন্তান জন্ম না দেওয়াটা তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরিবারের লোকজনেরা সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না। তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন যে সমস্যাটা আসলে তাঁর। শারীরিক সক্ষমতা না থাকার কারণে সন্তান হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে অনুত্তমা বললেন, ‘‘এখনও এ সমাজে সন্তান না হওয়াকে একটা কলঙ্কের অধ্যায় হিসাবে দেখা হয়। যেন এটা একটা ব্যর্থতা। একটা না পারা। কোথাও গিয়ে যেন বাকিদের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে পড়া। সন্তান ধারণ করতে না পারাটাই বড় করে দেখা হয়। সন্তান চাইনি— এটা যেন কোথাও গিয়ে ব্রাত্য হয়ে পড়ে। শারীরিক সক্ষমতা-অক্ষমতার উর্ধ্বে গিয়ে যে একটা নিজস্বতার গল্প আছে, সিদ্ধান্তের গল্প আছে সেটা হারিয়ে যায়।’’