কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের আরেক নাম ঝুলন। ছবি: সংগৃহীত
উচ্চতা ছ’ফুট এক ইঞ্চি। বাঙালি তনয়াদের মধ্যে এমন দৈহিক উচ্চতা খুব কমই দেখা যায়। তবে চমক শুধু সেখানেই নয়। তিনি ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়কও বটে। লম্বা বাঙালি মেয়ে খুঁজলে আরও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় ঝুলন গোস্বামীর খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের আরেক নাম ঝুলন। চলতি বছরের নভেম্বরে ৪০-এ পা দেবেন তিনি। অথচ তাঁর ফিটনেস কিন্তু সে কথা বলছে না। খেলোয়াড় মাত্রেই ফিট হবেন তা সকলে ধরেই নেন! কিন্তু এর নেপথ্যের পরিশ্রম অনেক সময় আড়ালেই থেকে যায়। শৈশবে ফুটবলের প্রতি একটা ভালবাসা তৈরি হলেও ৯২-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঝুলনের স্বপ্নের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চাকদহ থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে রোজ কলকাতায় আসতেন অনুশীলনের জন্য। পরিশ্রমের সেই শুরু। খেলার মাঠে ঘাম, রক্ত ঝরিয়েও যাতে ক্লান্ত হয়ে না পড়েন, সে ভাবে নিজেকে তৈরি করার যুদ্ধে নামতে হয় সব খেলোয়াড়কেই। ব্যতিক্রম নন ঝুলনও। ঠিক কতটা সাধনা করলে, প্রতি দিন কোন নিয়ম মানলে ঝুলন গোস্বামী হওয়া যায়, তা সরাসরি ঝুলনের থেকেই খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
আমি রোজ সকালে উঠে মাঠে দৌড়াতে যাই। ছবি: সংগৃহীত
খেলা বলে নয়, যে কোনও পেশাতেই ফিট থাকাটা অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করেন। সেই সঙ্গে পরিশ্রম এবং নিজেকে পুরোপুরি নিংড়ে দেওয়া তো রয়েছেই। ঝুলন অত্যন্ত বিনয়ী এবং আত্মবিশ্বাসীও। তাঁকে দেখে বয়স বোঝাই দায়। কিন্তু সে কথা শুনে খানিক হেসে ঝুলন বললেন, ‘‘আমার যে বয়স হচ্ছে তা ফিল্ডিং করতে গিয়ে বুঝতে পারছি। তবে আমার মনে হয় ফিট থাকার আসলে কোনও বয়স হয় না। সুস্থ-সবল থাকতে চাওয়ার ইচ্ছেটাই বড় কথা। এবং সেই ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে যা যা করা প্রয়োজন, ধারাবাহিক ভাবে তা মেনে চলা উচিত। আমি ছোট থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্তত পাঁচ-সাত বছর টিকে থাকতে হলে আমাকে বাড়তি ট্রেনিং করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। আমিও সেটাতেই বেশি করে সময় দিয়েছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুটিন বদলেছে। ট্রেনিং পদ্ধতি বদলেছে। ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কখনও। আমি রোজ সকালে উঠে মাঠে দৌড়াতে যাই। জিম করি। অনেক দিন পর্যন্ত খেলতে চাইলে এগুলি মেনে চলতেই হবে।’’
ঝুলন অত্যন্ত বিনয়ী এবং আত্মবিশ্বাসীও। ছবি: সংগৃহীত
সাধারণ মানুষ যে ধরনের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত, স্বাভাবিক ভাবেই ক্রিকেটার ঝুলন গোস্বামী সেই একই খাদ্যতালিকা মেনে চলেন না। বিধ্বংসী বলে প্রতিপক্ষকে মাঠের বাইরে পাঠাতে কী খান ঝুলন? তাঁর রোজের খাদ্যতালিকায় থাকে গ্লুটেনমুক্ত খাবার। গ্লুটেন একেবারেই খান না তিনি। ব্রাউন রাইস, ল্যাকটোজ হীন কাঠবাদামের দুধ তাঁর নিত্য সঙ্গী। চিনির স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছেন। কালো কফি খেতে ভালবাসেন। চা খেলেও ব্ল্যাক টি। প্রচুর মরসুমি ফল এবং যথেষ্ট পরিমাণে জল। রাতে ঘুমানোর আগে এক কাপ ক্যামোমাইল টি। ঝুলন বাঙালি রান্না তা হলে একেবারেই ভুলেছেন? একদমই নয়। সময়-সুযোগ হলেই লুচি, ছোলার ডাল, আলু পোস্তর স্বাদ নেন তিনি। মিষ্টি খেতে অসম্ভব ভালবাসেন। তা যদি হয় নলেন গুড়ের সন্দেশ, ঝুলনকে আটকায় তার সাধ্যি নেই ল্যানিং, হিলিরও! গোটা ক্রিকেট-জীবনে ১৯৭টি এক দিনের ম্যাচে ২৪৮টি এবং বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বাধিক উইকেট নেওয়ার প্রাপ্তির সঙ্গে মিষ্টির প্রতি ঝুলনের এই দুর্নিবার আকর্ষণ কোনও ভাবেই মেলানো যায় না। মিষ্টি খেলেও পরের দিনের শরীরচর্চার সময়টাও বাড়িয়ে নেন এই বাঙালি পেসার। ঝুলন ভারসাম্য বজায় রাখতে জানেন। জীবনে এবং মাঠেও।
মিষ্টি খেলেও পরের দিনের শরীরচর্চার সময়টাও বাড়িয়ে নেন এই বাঙালি পেসার। ছবি: সংগৃহীত
যে হাতে বাঙালি কন্যে জোরে বল করেন, ছক্কা হাঁকিয়ে বল গ্যালারির বাইরে পাঠিয়ে দেন, সে হাতে মাঝেমাঝে খুন্তিও কি ধরেন? ঝুলন জানালেন, ‘‘না ওই জায়গাটা ঝুলন গোস্বামী একেবারেই দুর্বল। আমার দৌড় ওই চা, কফি পর্যন্ত। খেতে যতটা ভালবাসি, রান্না করতে একদম ভালবাসি না। পারিও না।’’ খেলার সময় ভারতীয় জার্সি। অন্য সময়ে শার্ট ট্রাউজার্স। এর বাইরে কোনও পোশাক কি ঝুলন পরেন? শাড়ি পরেছেন কখনও? প্রশ্ন শুনে ঝুলনের কণ্ঠে আতঙ্ক, ‘‘পাগল নাকি! যে পোশাকটা পরে সামলাতে পারব না, ভয় লাগবে তা পরে কোনও লাভ নেই। খেলার জার্সি, শার্ট-ট্রাউজার, জিন্স, ওয়েস্টার্ন পোশাকেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ। কোনও দিন শাড়ি পরিনি এমন নয়। ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোতে বা ছোটখাটো কোনও অনুষ্ঠান পরেছি। ব্যস, ওই শেষ। বিশ্বকাপ খেলার চেয়ে শাড়ি সামলানো ঢের বেশি মুশকিল!’’ শাড়ি সামলাতে হিমসিম খেলেও ব্যর্থতা সামলাতে বেশ পারেন ঝুলন গোস্বামী। সাফল্য যেমন এসেছে, পাল্লা দিয়ে এসেছে ব্যর্থতাও। কী করে সামলেছেন নিজেকে? তাঁর কথায়,‘‘কেরিয়ারের গ্রাফ সব সময় এক সারিতে থাকে না। ওঠানামা তো থাকবেই। তা নিয়ে ভেঙে পড়লে চলবে না। ব্যর্থতা না এলে সাফল্যের স্বাদ পাওয়া যায় না। ব্যর্থতা অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। ’’আমির খান ঝুলনের পছন্দের অভিনেতা। শাহরুখও আছেন সেই তালিকায়। তবে আমির কানঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছেন। সিনেমা দেখে অবসর কাটে তাঁর। সুশান্ত দাস পরিচালিত ঝুলন গোস্বামীর বায়োপিক ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-এর শ্যুটিং প্রায় শেষের পথে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাবে ছবিটি। ঝুলনের চরিত্রে দেখা যাবে অনুষ্কা শর্মাকে। নিজের জীবনকে দর্শক হিসাবে চাক্ষুষ করার এমন সুযোগ সকলের হয় না। ঝুলন নিজেও তাই অত্যন্ত উত্তেজিত, খুশি তো বটেই। সে খুশির আভাস পাওয়া গেল তাঁর কথাতেই, ‘‘আমার বায়োপিক হচ্ছে। অবশ্যই ভাল লাগার মতো ব্যাপার। দর্শকের মতো আমিও অপেক্ষা করে আছি কবে দেখতে পাব।’’ যে প্রশ্নটা সকলের মনে ঘুরছে, সেটা শেষে করে ফেলা গেল। তিনি কি খুব তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে বিদায় নেবেন? উত্তরে ঝুলন জানালেন, ব্যর্থতা হোক বা সাফল্য, কোনও কিছুই যে তাঁকে খুব বেশি বিচলিত অথবা উত্তেজিত করে না। তাই তাঁর স্পষ্ট জবাব,‘‘জীবনে কোনও কিছুই আমার পরিকল্পনামাফিক হয়নি। নিজেও খুব পরিকল্পনা করে চলার মানুষও আমি নেই। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া নিয়ে বেশ কিছু জল্পনা শুনতে পাচ্ছি চারিদিকে। এখনও তেমন কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছইনি।’’