অনেক গল্প-সিনেমায় দেখা যায় কারও চোট লাগলে তার যমজ ভাই বা বোন তা টের পাচ্ছে। কিন্তু গল্প-কল্পনার বাইরে এগুলি কতটা সত্যি? অনেক সময়ে বাস্তবেও এমন বহু ঘটনা আমরা খবরে পড়ে থাকি। যমজদের মধ্যে নাকি একে অপরের দুঃখ-বেদনা অনুভব করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে।
অনেক গল্প-সিনেমায় দেখা যায় কারও চোট লাগলে তার যমজ ভাই বা বোন তা টের পাচ্ছে। কিন্তু গল্প-কল্পনার বাইরে এগুলি কতটা সত্যি?
নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় হিট বলিউড ছবি ‘জুড়ুয়া’-এ সলমন খানকে দেখে বেজায় মজা পেয়েছিলেন দর্শক। একই ছবির রিমেক হয় এক দশক পর। অভিনয় করেছিলেন বরুণ ধবন। সেই ছবির বক্স অফিস সাফল্যও কম ছিল না। যমজ ভাইদের আজগুবি কাণ্ড যতই হাসির খোরাক হয়ে ওঠে, তা হলে মন্দ কী! এক জন ভাইয়ের লাগলে অন্যেরও লাগছে, এক জনের হাসি পেলে, অন্য জনও অজান্তেই অকারণে হাসছে, এবং এই সব কীর্তিই নানা রকম হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে ছবিতে। যমজদের নানা কাণ্ড বারবার সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের বিষয় হয়ে উঠেছে। শুধু কমেডি নয়, নানা রকম ক্রাইম ড্রামাও হয়েছে যমজদের নিয়ে। যমজদের হালচাল নিয়ে গল্প-উপন্যাস-সিনেমা যতটা মেতে থাকে, ততটা তাঁদের নিয়ে উৎসাহী বিজ্ঞানও। যমজদের নিয়ে নানা রকম গবেষণা বিশ্বজুড়ে নানা সময়ে চলতেই থাকে।
যমজরা কি সত্যিই একে অপরের ব্যথা-বেদনা অনুভব করতে পারে? খবরে মাঝেমাঝে নানা রকম ঘটনার কথা জানা যায়। দেশের দু’প্রান্তে থেকেও এক জন টের পেয়েছিলেন তাঁর যমজ ভাইয়ের ভয়ানক বিপদ। দেখা গেল ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর যমজ ভাইয়ের গা়ড়ির দুর্ঘটনা হয়েছে! কিংবা এক জনের হঠাৎ প্রচণ্ড যন্ত্রণা হল পেটে, দেখা গেল শহরের অন্য প্রান্তে তাঁর যমজ বোনের হয়তো ফুড পয়েজনিং হয়েছে। নানা ধরনের বিচিত্র ঘটনা পড়ে অনেকেরই এই ধারণা তৈরি হয় যে, যমজরা বোধ হয় একে অপরের প্রত্যেকটি অনুভূতি টের পেয়ে যান সহজেই। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়ে ইএসপি বা এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন। এই নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি।
কিন্তু গবেষণায় তেমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়নি বললেই চলে। কিছু ঘটনা কাকতালীয়। অনেকটা লটারি জেতার মতো দেখতে পারেন বিষয়টি। ধরুন দু’জন যমজ বোন একই সঙ্গে লটারি জেতার যতটা সম্ভাবনা থাকে, তাঁদের দু’জনেরই একই নামের একই পেশার ব্যক্তিকে বিয়ে করারও ততটাই সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কোনও এক ব্যক্তি যে লটারি জিতবেনই, সেটার সম্ভাবনা যতটা বেশি, ততটাই বেশি সম্ভাবনা রয়েছে যে পৃথিবীতে কোনও না কোনও যমজ বোন সত্যিই একই নামের একই পেশার মানুষদের বিয়ে করবেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টুইন স্টাডিজ সেন্টার’-এর তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমী দেশগুলিতে ৮০ জন নবজাতদের মধ্যে অন্তত একটি যমজ সন্তানের জন্ম হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। যমজরা অন্য ভাইবোনের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ভাবে বড় হয়, তাঁদের পারস্পরিক টান অনেক বেশি থাকে, এবং এক জনের মৃত্যু হলে অন্য জন অনেক বেশি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। কিন্তু অনেক গবেষণা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছে, প়ৃথিবী জু়ড়ে মোটামুটি ১০ কোটি যমজ থাকলেও তার মধ্যে এই ধরনের কাকতালীয় ঘটনার সংখ্যা খুবই কম।
মনোবিজ্ঞানের নানা সমীক্ষা বলছে, একে অন্যের ব্যথা অনুভব করার ঘটনা যমজদের মধ্যে বেশ বিরল। কিন্তু সেই গল্প শুনে বাকি যমজরা, যাঁরা এমন কোনও ‘বিশেষ ক্ষমতা’র অধিকারী নন, তাঁরা এই কারণে বেশ হীনমন্যতায় ভোগেন। এবং ভাবেন তাঁদের মধ্যে বোধ হয় যথেষ্ট যমজসুলভ ক্ষমতা নেই!
যমজ মূলত দু’রকম— আইডেনটিক্যাল এবং ফ্র্যাটার্নাল। একই ভ্রূণ ভেঙে দুটি তৈরি হলে সেখান থেকে জন্ম নেয় আইডেন্টিক্যাল যমজ সন্তান। তাঁদের শারীরিক গঠন, চেহারা, ডিএনএ, মানসিক গঠন সবই এক রকম হয়। তাই তাঁদের যে একই রকম রোগ বা ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, সেটাই স্বাভাবিক। জন্মের পর দু’জনে একই ভাবে বেড়ে ওঠে। তাই অনেক সংক্রমণও দু’জনের মধ্যে এড়ানো সম্ভব নয়। এক জনের ম্যালেরিয়া হলে অন্যেরও হবে। এক জনের পেট খারাপ হলে অন্যেরও হবে— এটাই স্বাভাবিক। তাই দুই যমজ সন্তানই যদি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তা হলে তা খুব বিস্ময়কর নয়। খতিয়ে দেখলে হয়তো বোঝা যাবে দু’জনেই এক রকম অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতেন।
অনেক যমজ ভাইবোন হয়তো একই রকম কথা বলেন, একই রকম ভাবেন, একই সময়ে তাঁদের হয়তো কোনও এক ধরনের ইচ্ছা হতেই পারে। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, দম্পতি দীর্ঘ দিন ধরে বিবাহিত বা যাঁরা কাছাকাছি বয়সের ভাইবোন, তাঁদের চিন্তাভাবনাও অনেক সময়েই এক রকম হয়ে যায়। একই কথা এক সময়ে বলা, একই চিন্তা করা, একই রকম ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অজান্তেই একই জিনিস কিনে ফেলা, একই শরীর ভাষা বা কথা বলার ভঙ্গি— এগুলি সবই শুধু যমজ নয়, ঘনিষ্ঠ ভাইবোন বা দম্পতির মধ্যেও লক্ষ্যণীয়।
বিভিন্ন আঙ্গিকে করা বহু গবেষণা বলছে, যমজদের মধ্যে কোনও রকম একে অন্যের মনের কথা বোঝা বা বেদনা অনুভব করার বিশেষ কোনও ক্ষমতা থাকে না। বাস্তবে এমন কোনও উদাহরণ পাওয়া গেলেও তা নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।