আশপাশে ভালবাসার লোকজন থাকলে মনোরোগীরা খানিকটা ভাল ভাবে বাঁচতে পারবেন। প্রতীকী ছবি।
বিয়ের পরে স্বামী বা স্ত্রীর মনোরোগের কথা জানতে পারলে সংসার ভাঙে। বিয়ের আগে জানা গেলে তো কথাই নেই। সাহস করে অধিকাংশই সে সম্পর্কে এগোতে চান না। এ দিকে, মনোরোগী বলে সংসার চান না, সঙ্গীর প্রয়োজন নেই, এমন তো নয়। মনোরোগ যেমন চিকিৎসার মাধ্যমে সারানোর চেষ্টা করা দরকার, তেমনই তার পর সেই রোগীর জীবন কেমন হবে, তা নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। সে সব কথা চিন্তা করেই অভিনব পদক্ষেপ করেছেন এক চিকিৎসক।
মনোরোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে পাত্রপাত্রী খোঁজার ওয়েবসাইট। নাম ‘মনো ম্যারেজ’। সেখানে রেজিস্টার করেই খোঁজা যাবে মনের মানুষকে। কম্পিউটার কিংবা ফোন থেকে www.manomarriage.com ঠিকানায় গিয়ে দেখা যাবে সেই ওয়েবসাইট।
এমন ওয়েবসাইট যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, গত চল্লিশ বছর ধরে মনোরোগীদের চিকিৎসা করছেন তিনি। মহারাষ্ট্রের নাগপুরের বাসিন্দা চিকিৎসক অবিনাশ যোশী নিজে হাতেই তৈরি করেছেন ওয়েবসাইটটি। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘মনোরোগীদের চিকিৎসা করা তো হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু এই রোগীরাও যে খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর পরিবার-পরিজন চাইবেন। তা কোথা থেকে পাবেন? মনোরোগ নিয়ে যত ছুঁতমার্গ রয়েছে, তাতে সঙ্গী পাওয়া তো সহজ নয়।’’ সে সব ভেবেই পাত্রপাত্রীর খোঁজ করার ব্যবস্থার কাজে নামেন তিনি। মনে করেন, আশপাশে ভালবাসার লোকজন থাকলে মনোরোগীরা খানিকটা ভাল ভাবে বাঁচতে পারবেন।
বছর তিনেক ধরে চলছে ‘মনো ম্যারেজ’ ওয়েবসাইট। অল্প অল্প করে তার খবর ছড়িয়ে পড়ছে অনেকের মধ্যেই। তিন বছরে ৩০০ জন নাম লিখিয়েছেন এখানে। যাঁরা নাম লেখান, তাঁদের যত প্রশ্ন, সে সবের জবাব দেন চিকিৎসক নিজেই। ফোন হোক বা ইমেল, অন্য কাউকে সে সবের দায়িত্ব দেওয়াই বিশ্বাসী নন চিকিৎসক। অবিনাশ বলেন, ‘‘এ তো যে কোনও পাত্রপাত্রীর ব্যুরো নয়। মনোরোগীদের নিয়ে কাজ। চিকিৎসক কথা বললে ভরসা বাড়ে। আর তা ছাড়া, কে সংসার পাতার মতো অবস্থায় আছেন, কে নেই, তা-ও তো বুঝে নিতে হয়। তবে তো এগোতে পারবেন বাড়ির লোকজন।’’
এই ওয়েবসাইটে নাম লেখাতে হলে অবশ্য মনোরোগীদের আনতে হয় চিকিৎসকের সার্টিফিকেট। অবিনাশের বক্তব্য, যে চিকিৎসক এত দিন ধরে কোনও রোগীকে দেখছেন, তিনিই সবচেয়ে ভাল বুঝবেন তাঁকে। ফলে সেই ব্যক্তি কী পরিস্থিতিতে আছেন, তা চিকিৎসক লিখে দিলে তবেই তাঁর বিয়ের বিষয়টি নিয়ে এগোনো যায়।
ওয়েবসাইটে নাম লেখাতে জমা দিতে হয় ১৫০০ টাকা। এক বারই দেওয়ার। তার পর যত দিন খুশি এখানে নাম রাখা যায়। অবিনাশ বলেন, ‘‘একেবারে বিনামূল্যে করলে অনেকেই ওয়েবসাইটের গুরুত্ব না বুঝে নাম লিখিয়ে ফেলতে পারেন। তাতে কাজের কাজ হয়তো হবে না। কিন্তু আমার ব্যবসার জায়গা নয় এটি। তাই বেশি টাকা নেওয়া হয় না।’’ রেজিস্ট্রেশনের থেকে যা টাকা ওঠে, তা অবিনাশ পাঠিয়ে দেন নাগপুরের ‘মিউজিয়াম অফ ব্রেন অ্যান্ড মাইন্ড’-এ। একটি ট্রাস্ট চালায় সেই মিউজিয়াম। সেখানে বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়। তাই মিউজিয়াম চালাতে সেই ট্রাস্টকে এ ভাবে সাহায্য করেন অবিনাশ।
এই ওয়েবসাইটে যে শুধুই মনোরোগীরা নাম লেখাতে পারেন এমন নয়। যাঁদের মনোরোগ নেই, তাঁরাও সমান ভাবে স্বাগত বলে জানান অবিনাশ। তিনি বলেন, ‘‘বরং কোনও মনোরোগীর সঙ্গে যদি মানসিক ভাবে সুস্থ কেউ সংসার পাততে চান, তবে তো আরও ভাল। কারণ সে সংসার স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হলে কেউ মনোরোগের ইতিহাস লুকিয়ে বিয়ে করতে পারবেন না। সে দিক থেকে আবার অন্য ব্যক্তির জন্যও ভাল। সত্য জেনে এগোতে পারবেন তিনি।’’ কারণ মনোরোগীদের পরিবারের ক্ষেত্রে একটি আচরণ খুবই প্রচলিত। তা হল, মনোরোগের ইতিহাস গোপন করা। বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে। চিকিৎসক জানান, তা প্রধানত ব্রাত্য হওয়ার ভয়েই হয়। কিন্তু এ কথা লুকিয়ে যে লাভ হয় না। এক দিন না এক দিন তো জানাজানি হয়েই যায়।
এই ওয়েবসাইটে মনোরোগীর পাশাপাশি নাম লেখাতে পারেন যৌনতার নিরিখে প্রান্তে থাকা মানুষরাও। এমনকি, যাঁদের সন্তানধারণ সংক্রান্ত সমস্যা আছে, নাম লেখাতে পারেন তাঁরাও।
মনোরোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে পাত্রপাত্রী খোঁজার ওয়েবসাইট। নাম ‘মনো ম্যারেজ’। সেখানে রেজিস্টার করেই খোঁজা যাবে মনের মানুষকে। ছবি: সংগৃহীত।
মনোরোগ চিকিৎসক অবিনাশের এই উদ্যোগের কথা জেনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। তিনি বলেন, ‘‘একটি অভিজ্ঞতা বলি। এক জন মানুষ যিনি মনোরোগের কারণে কিছু দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন, এখন নিয়মিত ওষুধ খান, ডাক্তার দেখান, তাঁর অসুস্থতা তো সব সময়েই একেবারে নেই হয়ে যায়, এ রকম নয়। ফলে পরে কখনও নতুন করে কোনও সমস্যা হবে কি না, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়। আমাদের ‘অঞ্জলি’-র তরফ থেকে এই ধরনের মানুষদের স্বনির্ভর সামাজিক জীবনে শামিল করার প্রকল্প চলে। তিনি কী করতে চান, তা নিয়ে যখন তাঁর সঙ্গে আমার সহকর্মীরা কথা বলছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, তাঁর প্রথম পছন্দ সংসার করা। ওটাই তাঁর ইচ্ছা। ওঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু করতে পারব কি না, সেটা আমরা এখনও জানি না। আমি যত দূর বুঝেছি, ‘মনোম্যারেজ’ একটি ‘ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট’। আরও অনেক ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের মতো, এখানে কেউ এক জন পছন্দের মানুষ, যাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকতে চাইতে পারেন, তাঁকে খুঁজে পেতে পারেন। অন্য অনেক ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের থেকে এটা যেখানে আলাদা, এক জন শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, স্নায়ুর অসুখ আছে এমন কোনও মানুষ, যৌনতা বা সন্তান উৎপাদনে কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে, এমন কারও সঙ্গী খোঁজার জন্যই এই সাইটটি তৈরি হয়েছে।’’
রত্নাবলী জানান, এই উদ্যোগে কত জন মানুষ শামিল হন, কত জন তাঁদের মন মতো সঙ্গী খুঁজে পান, তা জানতে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এর বাইরে এই উদ্যোগ সম্পর্কে এক কথায় আর কিছু বলা মুশকিল। তার অনেকগুলি কারণ আছে। এক, নারী আন্দোলনের অবস্থান থেকে, দু’জন মানুষের একসঙ্গে থাকার ক্ষেত্রে আমি বিবাহকে একমাত্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে মনে করি না। আবার, এটাও ঘটনা যে, দু’জন মানুষ যদি বিবাহসূত্রে নিজেদের বাঁধতে চান, তা হলে, বিয়ে খুব খারাপ ব্যাপার বলে আমি তাঁদের সিদ্ধান্তকে বাতিল করারও বিরুদ্ধে। ধরুন, আমি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করার দাবি তুলে দু’জন মানুষের একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছি। আবার একই সঙ্গে দু’জন সমলিঙ্গের মানুষের বিয়ে করার অধিকার দাবি করি, সেখানেও রাষ্ট্রের উপর চাপানো অনুশাসনের বিরোধিতা করছি। প্রতিবন্ধীদের জন্য এ রকম কোনও উদ্যোগের কথা আমি বেশি শুনিনি। এই উদ্যোগ রাষ্ট্রের দিক থেকে হতে পারত। নিদেনপক্ষে কোনও সামাজিক উদ্যোগও হতে পারত। সেগুলি কিছুই যখন হয়নি, তখন একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে আমি আপত্তি জানানোর কোনও কারণ এখনও পাইনি। হ্যাঁ, যতটুকু বুঝতে পারছি, কিছু মানুষ কাস্টমার হিসাবে হয়তো সন্তুষ্ট নন, পছন্দ করে বেছে নেওয়ার মতো প্রচুর বিকল্প এখনও নেই। ওঁদের ওয়েবসাইটে সম্ভবত কিছু টেকনিক্যাল গ্লিচ এখনও আছে। যদি ওঁরা বাণিজ্যিক ভাবে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটটিকে সফল করে তুলতে চান, তা হলে নিশ্চয়ই ওঁরাও এই সমস্যাগুলিকে মিটিয়ে নেবেন। ইন্টারনেটের সুযোগ, কম্পিউটার নিদেন স্মার্টফোনের সুবিধে, একটা ন্যূনতম আর্থিক সঙ্গতি এগুলি এখানে পূর্বশর্ত। সেগুলি না থাকলে কেউ এই ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে সঙ্গী খোঁজার সুযোগ পাবেন না। এই সুবিধা যাঁদের নেই, তাঁদের জন্য এখনও তেমন কিছু ভাবা যায়নি যখন, তখন অন্তত এই সুযোগগুলি যাঁদের আছে, এবং যাঁরা এই ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের পরিষেবা নিতে চাইবেন, তাঁদের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাতে কোনও দ্বিধা নেই। তার সঙ্গে এটিও বলার যে, এই সঙ্গী খোঁজার প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষ প্রত্যাখ্যাত হবেন। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনা এত বেশি যে, এই সময়ে কেউ পাশে থাকলে তাঁদের হয়তো একটু সুবিধে হতে পারে।’’