লক্ষ্মণ মণ্ডল
এখনও পর্যন্ত ৪ হাজারেরও বেশি শবদাহ করেছেন তিনি।
একটি ছাড়া। বছর দশেক আগে তাঁর ছোটছেলের দেহের শেষকৃত্য করতে চেয়েও পারেননি। শ্মশানে যেতে চেয়েছিলেন। পরিজনরা (তিনি বলেন ‘বাড়ির লোক’) যেতে দেননি। কনিষ্ঠ আত্মজকে বাড়ি থেকেই চোখের জলে শেষবিদায় জানিয়েছিলেন বৃদ্ধ।
বয়স ৮৭। নাম লক্ষ্মণ মণ্ডল। তবে নাম হতেই পারত ‘গোপালখুড়ো’। শরৎচন্দ্র চাটুজ্যের ‘লালু’ গল্পের মূল চরিত্র। যাঁর জীবনের ‘ব্রত’ ছিল মড়া পোড়ানো। যে গোপালখুড়ো ‘কারও অসুখ শক্ত হয়ে উঠলে’ ডাক্তারের কাছে রোজ খবর নিতেন। ‘আশা নেই’ শুনলে খালি পায়ে গামছা কাঁধে ঘণ্টা দুই আগেই চলে যেতেন। শ্মশানবন্ধু হতে হবে তো! লক্ষ্মণের ব্রতও তা-ই।
মাত্র ১২ বছর বয়সে খুড়তুতো দাদা সাধনের সঙ্গে প্রথম ‘শ্মশানবন্ধু’ হওয়া হুগলির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা লক্ষ্মণের। তার পর গত ৭৫ বছর ধরে তিনি প্রায় ৪,২০০ শবদাহ করেছেন। এখনও একডাকে চলে যান শ্মশানে। ওটাই তাঁর নেশা। পেশা? নেই।
পড়াশোনা বেশি দূর করা হয়নি। অভাবের পরিবার। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েই লেখাপড়ায় ইতি। উত্তরপাড়ার মাখলায় একটি প্রাথমিক স্কুলে কাজ পেয়েছিলেন অশিক্ষক কর্মচারীর। তখন থেকেই তাঁর নাম ‘লক্ষ্মণ মাস্টার’। তবে অনেকে বলেন, শেষকৃত্যে লক্ষ্মণ একেবারে ‘মাস্টার’ বলেই ওই তকমা জুটেছিল তাঁর। বৃদ্ধ যদিও সেই নামের উৎপত্তি নিয়ে কিছু মনে করতে পারেন না। প্রশ্ন করলে বলেন, ‘‘ও সব কবেকার কথা! সে সব কী আর মনে আছে। তবে আমি একটা নাইট স্কুলে পড়াতাম। সে কারণেও লোকে মাস্টার বলে ডাকতে পারে। মনে নেই গো।’’
এলাকায় কেউ মারা গেলেই ডাক পড়ে লক্ষ্মণের। সঙ্গে সঙ্গে হাজির তিনি। এই ৮৭ বছরেও। বলছিলেন, ‘‘এখন তো ইলেকট্রিক চুল্লি হয়েছে। শববাহী গাড়ি রয়েছে। সরকারের সমব্যথী প্রকল্প এসেছে। একটা সময় ছিল, যখন বাঁশ কেটে চালি বানাতে হত। কাঁধে করে দেহ নিয়ে যেতে হত। কাঠের চুল্লি বানাতে হত।’’ একটা সময় লক্ষ্মণ একাহাতে সে সব করেছেন। এখনও করেন। তাঁর কথায়, ‘‘এখনও সে সব করতে হয়। গরিব মানুষ তো কম নেই চার দিকে। আর এ সব কাজের জন্য লোকও পাওয়া যায় না তেমন।’’ টানা ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতা বলছিল, ‘‘কাঠে দাহ করতে অনেক সমস্যা। কায়দাটা না জানলে আগুন নিভে যায়। বর্ষাকালে তো আরও জ্বালা। সবটাই ওই ফুটবল খেলার মতো। পায়ের কাজ না থাকলে হবে না।’’
লক্ষ্মণ মড়া পোড়ানোর ‘ব্রত’ ছাড়েননি। যেমন অভাবও কখনও ছেড়ে যায়নি তাঁকে। একটা সময়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন। যাত্রায় ছুটকো অভিনয় করেছেন। এখন আর কোনও কাজ নেই তাঁর। নাকি আছে? তাঁর একটিমাত্রই কাজ আছে— শেষকৃত্য। বার্ধক্যভাতার টাকায় দিন চলে যায় কোনওক্রমে। বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী। তিন ছেলের মধ্যে বড় দু’জনের সঙ্গে লক্ষ্মণের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। ছোট ছেলের বিধবা স্ত্রী সংসার চালান। কোনও রকমে দিন গুজরান হয়। কিন্তু বৃদ্ধের আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। বলছিলেন, ‘‘এ ভাবেই চলে যাচ্ছে। কারও কাছে হাত পাতি না।’’
নিজে গরিব। কিন্তু লক্ষ্মণ মাস্টার লোকবলহীন গরিবের ভরসা। শবদাহের পাশাপাশি এলাকার লোকজনের কাছে নিজেই হাত পাতেন দুঃখী পরিবারের জন্য। কাপড়, খাওয়াদাওয়া— সাহায্যের হাত বাড়ান। কোনও স্বীকৃতির আশা করেন না। স্থানীয় ক্লাব বা সংগঠন দু’এক বার সংবর্ধনাও দিয়েছে। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘মানুষের জন্য, তাদের পাশে থাকার তাগিদে এই কাজটা করি। ছেলেপুলেদের অনেককে নিজের হাতে কাজটা শেখাই। কী ভাবে খাট বাঁধতে হয়, কী ভাবে দেহ তুলতে হয় চুল্লিতে। কারও কাছ থেকে একটা পয়সাও নিই না। এক বার ওড়িশা থেকে একটা বডি এসেছিল। ওরা জোর করে আমাকে ২০০ টাকা দিয়েছিল। ‘নেব না’ বলেও পার পাইনি। কিন্তু ওই একবারই।’’
ভূতের ভয় নেই উত্তরপাড়ার ‘গোপালখুড়ো’র। নেই মৃত্যুভয়ও। তবে এক বার একটু চমকে গিয়েছিলেন। ময়নাতদন্ত-হওয়া একটা দেহ চুল্লির আগুনে পোড়া শুরু হতেই তার সেলাই কেটে যায়। কাঠের চুল্লি ঠেলে দেহ বেরিয়ে আসে। রাতের সেই দৃশ্য দেখে লক্ষ্মণের এক সঙ্গী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তিনি চমকালেও ভয় পাননি। ‘সহকর্মী’র ঘাড়ে-মাথায় জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলেন। স্বাভাবিক। গল্পের ‘গোপালখুড়ো’ তো বলেইছিল, ‘‘ভয় দেখাবি আমাকে? যে হাজারের উপর মড়া পুড়িয়েছে। তাকে?’’
ভয় নেই। কষ্ট আছে। কনিষ্ঠ সন্তানের চলে যাওয়ার কষ্ট। ভোর রাতেও কথা হয়েছিল ৩৫ বছরের প্রফুল্লর সঙ্গে। ভোরে আচমকা ‘স্ট্রোক’। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সব শেষ। লক্ষ্মণ ভেঙে পড়লেও যেতে চেয়েছিলেন শ্মশানে। নিজের হাতেই সন্তানের সৎকার করতে। কারণ, লক্ষ্মণ মনে করেন শেষকৃত্যই জীবনের একমাত্র ‘শুভকাজ’। কিন্তু স্ত্রী এবং অন্য সন্তানরা তাঁকে যেতে দেননি। সে দিনের কথা বলতে গিয়ে ভিজে যাচ্ছিল ৮৭ বছরের চোখ, ‘‘এদিককার সব শ্মশানের লোকজন আমায় চেনে। ঘাটকাজের খরচ কিছুটা কম নিত। এত হাজার হাজার লোককে নিজের হাতে বিদায় দিলাম। নিজের ছেলেকে দিতে পারব না! খুব কষ্ট হয়েছিল। শেষ অবধি পারিনি। বাড়িতে বসে শুধু কেঁদেছি। মনে হয়েছে, ছেলেটাকে যাওয়ার সময় একটু যত্নও করতে পারলাম না!’’
কাহিনির চেয়ে জীবন আসলে বেশি অদ্ভুত হয়। বাস্তবের লক্ষ্মণ মাস্টারের জীবন হারিয়ে দেয় গল্পের ‘গোপালখুড়ো’-কে।