গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুরু করেছিলেন রাত পৌনে ১২টায়। শেষ করলেন ভোর সাড়ে চারটেয়। আধখাওয়া রুটি-সব্জি থালায় পড়ে রইল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। তত ক্ষণে রুটি চামড়া হয়ে গিয়েছে। সব্জি ঠান্ডায় গোবর।
তাতে অবশ্য অরূপ ধাড়ার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন কত অজস্র রুটি-সব্জি তাঁর গ্রাসের অপেক্ষায় পড়ে থেকেছে রাতের পর রাত।
তিনটে রুটির সবে একটা শেষ হয়েছে। সব্জির বাটি তখনও খালি হয়নি। তখন আবার ফোনটা এসেছিল। প্রবল ঠান্ডায় মায়ের মরদেহ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরতে পারছেন না মহাদেব দোলই। রাতের খাবার ফেলে স্ত্রীকে ‘‘একটু বেরোচ্ছি, এসে খাব’’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অরূপ। সোজা পুরসভা। শববাহী গাড়ির চালকের খোঁজে। কিন্তু মধ্যরাতে তিনিও অমিল। অগত্যা নিজেই শববাহী গাড়ি চালিয়ে সটান ঘাটাল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন অরূপ। মহাদেবের মা লক্ষ্মী দোলইয়ের মরদেহ সেই গাড়িতে তুলে তাঁদের বাড়ি। শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরেছিলেন।
স্থানীয়দের হাতে বেবিফুড তুলে দিচ্ছেন অরূপ। —নিজস্ব চিত্র।
আধখাওয়া রুটি-সব্জিটুকু যখন গলায় চালান করেছিলেন, তত ক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে।
অরূপের ‘বন্ধুতা’র এমন উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। তবে তাঁর পেশা চাষবাস। আর নেশা রাজনীতি। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে তাঁর পরিচয় মানুষের ‘বিপদের বন্ধু’। তাঁর পছন্দের পরিচয়ও বটে। তাই তিনি সাধারণের মধ্যে ‘অ-সাধারণ’। আরও অসাধারণ, কারণ, পেশায় রাজনীতিক অরূপ চান তাঁর রাজনীতির প্রচার হোক। কিন্তু বন্ধুতার কাহিনি যেন বেশি লোকে না পড়ে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার জয়ন্তীপুরে থাকেন অরূপ। চল্লিশের কোঠায় বয়স। আপাতত চন্দ্রকোনা পুরসভার প্রশাসক মণ্ডলীর প্রধান। অর্থাৎ, প্রাক্তন চেয়ারম্যান। কিন্তু মানুষের সুখদুঃখের দিনে ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠার পিছনে অরূপের কোনও রাজনীতি নেই। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বহু পড়ুয়ার টিউশনির খরচ তিনি চালান। বইপত্র কিনে দেন। করোনা-কালে এলাকার বহু পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেই সব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন অরূপ। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে। শিশুদের ‘বেবিফুড’ কিনে দেওয়ার পাশাপাশি সমস্ত দরিদ্র মানুষকে দিয়েছেন জামাকাপড়। এমনকি খাবারদাবারও। নিয়মিত। আবার বলা থাক, ব্যক্তিগত ভাবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে। নিভৃতে। কোনও প্রচার না চেয়ে।
লক্ষ্মীদেবীর শেষকৃত্যের ব্যবস্থাটুকু করতে পারলেও তাঁকে প্রাণে বাঁচাতে না পারায় আক্ষেপ আছে অরূপের। —নিজস্ব চিত্র।
সে দিন অত রাতে বাড়ি থেকে রাতের খাবার ফেলে শববাহী গা়ড়ি নিজে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় পরিবারের লোকজন আপত্তি করেননি? করেননি। কারণ, অরূপ বাড়িতে কিছু বলেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো বাড়িতে বলে বেরোইনি। বলেছিলাম, একটু ঘুরে আসছি। তার পর খাব। বলে গেলে হয়তো আটকানোর চেষ্টা করত।’’ সঙ্গে হাসিতে জোড়েন, ‘‘বারণ করলেও অবশ্য আমি শুনতাম না। সেটা ওরাও জানে। কম বছর তো হল না এ সব নিয়ে!’’
তবে মহাদেবের মা লক্ষ্মীদেবীর শেষকৃত্যের ব্যবস্থাটুকু করতে পারলেও তাঁকে প্রাণে বাঁচাতে না পারায় আক্ষেপ আছে অরূপের। তিনিই অসুস্থ প্রৌঢ়াকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাতে তাঁর মৃত্যুর খবর আসে। ভেবেছিলেন, মরদেহ বাড়িতে পৌঁছনোর পর একবার গিয়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গিয়েছিল মহাদেবের ফোনে। কোনও শববাহী গাড়ি নেই। গাড়ি আছে তো চালক বেপাত্তা। অরূপ দেরি করেননি। স্ত্রী নমিতাকে বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভোরবেলা যখন ফেরেন, স্ত্রী অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অরূপের ডাকেই ঘুম ভাঙে তাঁর। বাড়ি ফিরেও অরূপ তাঁকে কিছু বলেননি। পরে বলেছিলেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে অরূপ বলছিলেন, ‘‘অত রাতে পুরসভার গাড়িচালককে পাওয়া যায়নি। তাই নিজেই এক জনকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলাম। উনি সুস্থ হয়ে উঠলে খুশি হতাম। কিন্তু মৃত্যুর পরেও যে তাঁর পরিবারের কাজে আসতে পেরেছি, সেটার জন্য জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারলে আমার ভাল লাগে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।’’
কৃষক পরিবারের ছেলে এখনও মাঝে মাঝে চাষের কাজেও হাত লাগান। পরিবারের প্রায় ১২ বিঘা জমি রয়েছে। আর্থিক নিরিখে মধ্যবিত্ত পর্যায়ের চাষি। রাজনীতির হাতেখড়ি চন্দ্রকোনা কলেজে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে উঠে পুরসভার চেয়ারম্যান। কিন্তু সে তাঁর রাজনীতির যাত্রা। অরূপের মানবনীতির যাত্রা চলে সমান্তরালে। আর বাবা মাধব, মা মেনকা, স্ত্রী নমিতা, পুত্র অগ্নি ও কন্যা অন্বেষা ভাবেন, ‘রাজদ্বারে, শ্মশানে চ, যস্তিষ্ঠতি স বান্ধব’।