৭৩ বছর বয়স। ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। রুগ্ন চেহারার সেই মানুষটি যখন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এসে নিজের হাতে রান্না করতেন, তাঁর আন্তরিকতায় হৃদয় ভরে আসত বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফলোয়ারদের।
সারা বিশ্ব তাঁকে ‘গ্র্যান্ডপা’ নামেই চিনতেন। কখনও তাঁর প্রকৃত নাম-ধাম জানার যেন প্রয়োজনই হয়নি কারও। ৭৩ বছরের সেই গ্র্যান্ডপা রবিবার বয়সজনিত অসুখে মারা গেলেন। অসহায় করে গেলেন সেই সব অনাথ শিশুদের, যারা তাঁর জন্যই প্রতি সপ্তাহে সুস্বাদু খাবার খেতে পারত।
গ্র্যান্ডপার আসল নাম নারায়ণ রেড্ডি। তেলঙ্গানার বাসিন্দা নারায়ণ চাষাবাদ করেই জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সব সময়ই অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিল। অর্থের অভাবে তিনি তেমন কিছুই করে উঠতে পারতেন না।
২০১৭ সালে তিনি প্রথম নিজের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পান। তেলঙ্গানার কয়েকজন যুবক তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। ইট দিয়ে উনুন বানিয়ে তিনি অনাথাশ্রমের শিশুদের জন্য খাবার তৈরি করতে শুরু করেন।
তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়া ওই যুবকদের প্রেরণাতেই ২০১৭ সালে অগস্টে ‘গ্র্যান্ডপাজ কিচেন’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলেন নারায়ণ রেড্ডি। আর তখন থেকে গ্র্যান্ডপার জার্নি শুরু।
গর্ত করে তার উপর ইট সাজিয়ে উনুন বানানো। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনা, আর তারপর সেই কাঠের টুকরো দিয়ে উনুন ধরানো। এ ভাবেই শুরু হত গ্র্যান্ডপার রান্না।
কখনও মটন বিরিয়ানি, কথনও পিত্জা, কেক আবার কখনও বার্গার, নুডলস বানিয়ে তিনি অনাথাশ্রমে দিয়ে আসতেন।
প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার তিনি রান্না করতেন। বড় কড়াই, হাতা নিয়ে সেই রান্নার পুরো প্রণালীটাই ভিডিয়ো করা হত। তারপর সেটা ইউটিউবে আপলোড করা হত।
এ ছাড়াও তিনি নানা রকমের পুডিং, কেক, মিল্কশেক, চিপস, ডিমের নানা রেসিপি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এ রকম নানা রকম রেসিপি নিয়ে হাজির হতেন। কোন দিন কী খাওয়াতে চলেছেন তা আগে থেকে শিশুদের জানিয়েও দিতেন।
প্রতিটা ভিডিয়ো শুরুই হত গ্র্যান্ডপার ইংরাজি সংলাপ দিয়ে। পুরো ভিডিয়োতে তিনি ইংরাজিতেই কথা বলতেন।
২০১৭ থেকে ২০১৯ এই দু’বছরে তিনি ২২০ রকম পদ রান্না করেছেন তিনি। এই মাত্র দু’বছরেই তাঁর ইউটিউব ফলোয়ার ৬০ লক্ষ ১১ হাজার। আর ফেসবুক ফলোয়ার ৫ লাখ ৩০ হাজার!
এখনও পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় রেসিপি হল ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। এই রেসিপির ভিউ হয়েছিল ৩৭ কোটি। আর দ্বিতীয় জনপ্রিয় রেসিপি হল ১০০ ম্যাগি প্যাকেট দিয়ে নুডলস রেসিপি।
প্রতিটা ভিউয়ারেরই অত্যন্ত প্রিয় মানুষ ছিলেন নারায়ণ। তাঁর প্রতি ভিডিয়োর নীচে কমেন্ট করতেন ভিউয়াররা। অনেকে তাঁকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেন।
গত রবিবার গ্র্যান্ডপার মৃত্যু হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার তাঁর একটা শেষযাত্রার ভিডিয়ো ইউটিউবে আপলোড করার আগে পর্যন্ত কেউই তাঁর মৃত্যুর খবর পাননি।
তবে মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে শেষবারের মতো গ্র্যান্ডপা একটা ভিডিয়ো করেছিলেন। তাতে তিনি শারীরিক পরিস্থিতির কথা সমস্ত ফলোয়ারদের জানিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র ‘গ্র্যান্ডপাজ কিচেন’-এ শোকবার্তার ঢল নেমেছে। ভক্তরা ইউটিউবেই বিদায় জানালেন তাঁদের প্রিয় গ্র্যান্ডপাকে।
তবে ‘গ্র্যান্ডপাজ কিচেন’ বন্ধ হবে না। অনাথ শিশুদের খাওয়ানোর যে স্বপ্ন নারায়ণ দেখেছিলেন, তা পূর্ণ করার কথা জানিয়েছেন তাঁর সহকর্মীরা। গ্র্যান্ডপার শেষযাত্রার ভিডিয়োয় তা জানিয়েছেন করেছেন তাঁরা।
গ্র্যান্ডপার কিচেনে কোনও আভিজাত্য ছিল না। একেবারেই ঝাঁ চকচকে নয়। বরং ঘাসের উপরে, খোলা আকাশের নীচে সাদা জামা আর লুঙ্গি পরে রান্না করতেন তিনি। কিন্তু তাঁর আন্তরিকতা অনাথ শিশুদের কাছে সেই রান্নার স্বাদ বড় রেস্তোরাঁকেও হার মানাত।