(বাঁ দিক থেকে) কিষেণজি, আজাদ, সুধাকর রেড্ডি, চলপতি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
দেড় দশক আগে বাংলায় নিহত মাওবাদী পলিটব্যুরো সদস্য মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির সঙ্গে তাঁর তুলনা টানছেন অনেকেই। বলছেন, কিষেণজির পর নিষিদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী)-র এত বড় মাপের কোনও নেতা নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হননি। তিনি রামচন্দ্র রেড্ডি ওরফে চলপতি। সোমবার রাতে ওড়িশা সীমানা লাগোয়া ছত্তীসগঢ়ের গরিয়াবান্দ জেলায় ১৯ জন সঙ্গী-সহ নিহত হয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির এই প্রভাবশালী সদস্য।
দিনটা ছিল ২০০৪-এর ২১ সেপ্টেম্বর। ভারতে অতিবাম সশস্ত্র ‘আন্দোলন’ সে দিন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার (এমসিসি) এবং জনযুদ্ধ (সিপিআই-এমএল-পিডব্লিউজি) মিশে জন্ম হয়েছিল নতুন সংগঠন সিপিআই (মাওবাদী)-র। ওই সংযুক্তিকরণ উপলক্ষে ‘মিলন সমাবেশ’ হয়েছিল রাজ্যে রাজ্যে (এ রাজ্যের ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ির চাকাডোবায় হয়েছিল)। সেই সমাবেশগুলি থেকেই উঠে এসেছিলেন নতুন নেতৃত্ব।
তার পর গত দু’দশকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দেশের বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে চলেছে রক্তাক্ত লড়াই। নিষিদ্ধ হয়েছে সিপিআই (মাওবাদী)। তাদের সশস্ত্র বাহিনী পিএলজিএ (পিপল্স লিবারেশন গেরিলা আর্মি)-র হানায় কয়েক হাজার কেন্দ্রীয় আধাসেনা, পুলিশ এবং সাধারণ গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। পাল্টা আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে মাওবাদী নেতা-কর্মীদের অনেকেরই। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন চলপতি এবং তাঁর ১৯ জন সঙ্গী। কিষেণজির পর মাওবাদী বাহিনীর এত বড় মাপের কোনও নেতা নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হননি বলে ছত্তীসগঢ় পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি।
রবিবার রাত থেকে ওড়িশা-ছত্তীসগঢ় সীমানায় সিআরপিএফের কোবরা কমান্ডো, ওড়িশা পুলিশের মাওবাদী দমন বাহিনী এসওজি, ছত্তীসগঢ় পুলিশের ‘ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ড’ (ডিআরজি) বাহিনীর ধারাবাহিক যৌথ অভিযানে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছে চলপতি এবং তাঁর সঙ্গীদের। মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চলপতির ‘মাথার দাম’ ছিল এক কোটি টাকা। তাঁর মৃত্যু মাওবাদী বাহিনীর পক্ষে বড় ধাক্কা। আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জবানিতে, ‘‘আমাদের বড় সাফল্য।’’
আপ্পারাও, রামু, জয়রাম-সহ নানা ছদ্মনাম থাকলেও রামচন্দ্রের পরিচিত ছিল ‘চলপতি’ নামে। ছত্তীসগঢ়ের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশে একাধিক নাশকতার মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন ৬০ বছরের এই মাওবাদী নেতা। অন্ধ্রপ্রদেশের রায়লসীমা অঞ্চলের চিত্তুর জেলার মদনাপল্লের বাসিন্দা চলপতি ছেলেবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই আশির দশকের গোড়ায় স্কুল ছেড়ে সিপিআইএমএল (পিডব্লিউজি)-র হাত ধরে ‘সশস্ত্র বিপ্লবে’ যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে চলপতির সঙ্গে ৮-১০ জন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী থাকার কথা। সম্ভবত, তাঁদের সকলেই নেতাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বস্তারের জঙ্গলে।
ঘটনাচক্রে, গত দু’দশকে যে মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যেরা এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সকলেই জনযুদ্ধের ‘ফসল’। এঁদের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের মাটিতে সে রাজ্যের পুলিশের মাওবাদী দমন বাহিনী গ্রে হাউন্ডের অভিযানে নিহত হয়েছিলেন সন্দে রাজামৌলি, পটেল সুধাকর রেড্ডি এবং চেরুকুরি রাজকুমার ওরফে আজাদ। ২০০৭ সালে অন্ততপুরে নিহত হয়েছিলেন রাজামৌলি, ২০১০-এ অন্ধ্রের আদিলাবাদে পলিটব্যুরো সদস্য আজাদ এবং ২০১২ সালে ওয়ারঙ্গলে সুধাকর। ঘটনাচক্রে তাঁদের তিন জনকেই জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করে সাজানো সংঘর্ষে খুনের অভিযোগ উঠেছিল।
একই অভিযোগ উঠেছিল বাংলায় নিহত অন্ধ্রের মাওবাদী নেতা ওরফে কিষেণজির ক্ষেত্রেও। যদিও পুলিশের দাবি, ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর ঝাড়গ্রামের বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল কিষেণজির। তাঁর ভাই মাল্লোজুলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি ওরফে বিবেক ওরফে সোনু বর্তমানে মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সোনুর স্ত্রী তথা সিপিআই (মাওবাদী) দণ্ডকারণ্য জ়োনাল কমিটির নেত্রী বিমলা চন্দ সিদাম ওরফে তারাক্কা গত ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের গঢ়ছিরৌলিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ২০২১ সালে মহারাষ্ট্রে গঢ়ছিরৌলিতেই সে রাজ্যের পুলিশের মাওবাদী দমন বাহিনি সি-৬০-এর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান কেন্দ্রীয় কমিটির আর এক সদস্য মিলিন্দ তেলতুম্বড়ে। এ ছাড়া, ২০১৬ সালে অন্ধ্র-ওড়িশা-ছত্তীসগঢ় সীমানায় সংঘর্ষে দয়া ওরফে গারলা রবি, গণেশ এবং মল্লেশের মতো কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্যের মৃত্যু হয় বলে দাবি পুলিশের।