তছনছ: সাম্প্রতিক ট্যাব কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বিক্ষোভ, কৃষ্ণনগর, ২২ নভেম্বর। —প্রণব দেবনাথ।
যথারীতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ট্যাব দুর্নীতি নিয়ে শোরগোল। ঊহ্য রইল অনেক বড় গন্ডগোল, যাকে বলা চলে ট্যাব নীতি।
ট্যাবলেটের দাম ১০,০০০ টাকা। ১৬,০০,০০০ পড়ুয়াকে বিতরণে খরচ ১৬০০ কোটি। যদি একশো জন শিক্ষাবিদকে জিজ্ঞাসা করা হয়, অর্থক্লিষ্ট রাজ্যে শিক্ষার উন্নতিসাধনে এতগুলো টাকার ফলপ্রসূ ব্যয় কী হতে পারে, এক জনও বলবেন না সবটা দিয়ে পড়ুয়াদের ট্যাবলেট কিনে দাও। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পরিবেশ ও পরিকল্পনা আমাদের স্কুলব্যবস্থায় আছে কি? পাঠ্যক্রমের কত অংশ এই মাধ্যমে পড়ানো হয়? আন্তর্জালের শিক্ষামূলক ব্যবহারে ছাত্রদের কি তালিম দেওয়া হয়?
আরও ঢের গুরুতর প্রশ্ন আছে। অর্থাভাবে সরকারপোষিত স্কুলব্যবস্থায় অশেষ ঘাটতি। বিজ্ঞানশিক্ষার মৌলিক উপকরণ ও পরিকাঠামো কোথায় কতটা আছে? অনেকগুলি আন্তঃস্কুল বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র একদা তৈরি হয়েছিল, আজ বহু কাল তালাবন্ধ। বহু দিন পর এ বছর বিজ্ঞানশিক্ষা বাবদ স্কুলগুলি কিছু টাকা পেয়েছে, যেমন পেয়েছে গ্রন্থাগার বাবদ। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল গ্রন্থাগারের সংখ্যা সন্তোষজনক, কিন্তু বই আসে কি ও ক’টা? ক’টা স্কুলে গ্রন্থাগারিক আছেন?
কিছু স্কুল ভবন জমকালো, বেশির ভাগই মলিন ও ভগ্নপ্রায়। ছাদের দশা বিপজ্জনক, রান্না-খাবার জায়গা, শৌচাগার অস্বাস্থ্যকর, স্কুলবাড়িটাই নদীর ভাঙনে তলিয়ে গেছে বা হাতিতে তছনছ করেছে। বহু গ্রামীণ স্কুলের রাস্তা বেহাল; বর্ষায় ছেলেমেয়েরা ঝুঁকি নিয়ে পড়তে আসে। কোনও প্রাথমিক স্কুলে অফিসকর্মী নেই: প্রধান শিক্ষকের বিপুল সময় যায় প্রশাসনিক কাজে। অন্তত কয়েকটি স্কুলের জন্য এক জন অফিসকর্মীর সংস্থান হলে শিক্ষকদের শিক্ষাদানের অবকাশ জুটবে।
এই অজস্র ঘাটতি পূরণের বদলে ট্যাবলেট কেনা কি রুটির অভাবে কেকের জোগান হয়ে যাচ্ছে না? সবচেয়ে বৃহৎ ও কঠিন সমস্যা হল শিক্ষকের নিদারুণ অভাব। অভাবটা সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ অপশাসনে; শেষে আদালতের কোর্টে বল গড়ানোয় সরকার যেন ফুরসত ভোগ করছে। উচ্চ প্রাথমিকের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, সমস্যা পুরো মিটেছে কি? সর্বত্র শিক্ষক পৌঁছেছে? অন্যান্য স্তরের নিয়োগ এখনও অথৈ জলে। লেখাপড়া তবে চলছে কী করে? সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল কি, আইন বাঁচিয়ে কিংবা আদালতের অনুমতি নিয়ে শিক্ষাদানের ঘাটতি পোষাতে একটা সাময়িক ব্যবস্থা চালু করা? অন্তত আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির বদলে তা যথাসম্ভব ত্বরান্বিত করা?
পরিবর্তে জোর দেওয়া হচ্ছে অর্থ বা উপহার বিতরণের নির্বাচনসিদ্ধ কৌশলে। সেটাও যথেষ্ট ইতিবাচক হতে পারে। কন্যাশ্রী প্রকল্প মেয়েদের কেবল অর্থদান করেনি, দরদ ও আশ্বাসের বার্তা পাঠিয়েছে, প্রশাসনে এনেছে বিরল মানবিক ছোঁয়া। সবুজ সাথী মেয়েদের সামাজিক ক্ষমতায়নের রসদ জুগিয়েছে। রাজ্য সরকারের নানা বৃত্তিতে প্রচুর ছেলেমেয়ে উপকৃত হচ্ছে, বিশেষত যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার বৃত্তির পরিধি গুটিয়ে আনছে। ট্যাব-কাণ্ড এ সব উদ্যোগের উপসর্গ।
মুশকিল এই, আসল পঠনপাঠন ও শিক্ষা পরিচালনায় তাল রেখে উন্নতি ঘটেনি, বরং অবহেলা ও অনাচারের ফলে ক্রমশ হাল খারাপ হয়েছে। ফলে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের মনে কেবল শিক্ষাব্যবস্থা নয়, শিক্ষার ধারণাটা সম্বন্ধেই অশ্রদ্ধা দানা বাঁধছে, বিশেষ করে অতিমারির পর থেকে। প্রচুর ছেলেমেয়ে আজ কলেজে নাম লিখিয়ে কোনও-না-কোনও সরকারি বৃত্তি পাচ্ছে, কিন্তু কলেজের বদলে হাজিরা দিচ্ছে হরেক অসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, কর্মসংস্থানের অলীক আশায়। প্রত্যন্ত গ্রামেও গজিয়ে উঠছে তথাকথিত ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল, যার কাঠামো আর শিক্ষণপদ্ধতি দেখে আঁতকে উঠতে হয়। মূল রাষ্ট্রপোষিত শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব কার্যত কমে আসছে। আরও মারাত্মক কথা, ব্যবস্থাটা চলে যাচ্ছে অন্তঃসারশূন্যতার দিকে।
বিপদ কিন্তু একটা নয় দুটো, এবং দ্বিতীয়টা আরও মোক্ষম। রাজ্য সরকার ক্ষতিসাধন করছে প্রকট ও তরল ভাবে। কেন্দ্রের শিক্ষাকৌশল একই পরিণতির দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে সুচিন্তিত, সার্বিক ও পাকাপোক্ত ভাবে। ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতি এক বিচিত্র নথি। কাঁচি আর আঠা নিয়ে তা থেকে একেবারে বিপরীতধর্মী দুটো শিক্ষানীতি ফাঁদা যায়। অনেক সদুপদেশ এতই গোল গোল অনির্দিষ্ট যে কার্যত মূল্যহীন। এই সর্বংসহা দলিলের ছত্রছায়ায় যে বাস্তব পদক্ষেপগুলি করা হচ্ছে তা শিক্ষাক্ষেত্রকে অসম ও খণ্ডিত করে তুলছে, সঙ্কুচিত করছে তার পরিসরকে। এমনও বলা আছে যে, সব ছেলেমেয়ের পূর্ণ সময়ের স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। কয়েকটি অতিসরল মাপকাঠির প্রয়োগে যেমন বিদ্যায়তন তেমনই ব্যক্তি-ছাত্র ও শিক্ষকদের শ্রেণিভাগ করা হচ্ছে। সেই শ্রেণিপরিচয়ে নির্ধারিত হচ্ছে অর্থবরাদ্দ, সামাজিক স্বীকৃতি ও উন্নতির সুযোগ।
বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে এই বৈষম্য উৎকট পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোনও অবান্তর উপসর্গকে নীতির মর্যাদা দিয়ে সেটা লঙ্ঘনের অভিযোগে মৌলিক জনসেবা স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকা বহু কাল বন্ধ ছিল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালগুলি এক বিশেষ রঙে রঞ্জিত নয় বলে।
হ য ব র ল-র সেই চরিত্রের মতো কেন্দ্রের শাসকেরা বড়ই নামকরণপ্রিয়। শিক্ষার মতো যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়েও তাঁরা একতরফা বিভিন্ন প্রকল্পে রাজনৈতিক সুবিধাজনক নাম জুড়ে দেন, এবং রাজ্য সেটা না মানলে টাকা বন্ধ করে দেন, ৪০% অর্থ যদিও রাজ্যই দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিতর্ক ‘পিএমশ্রী’ স্কুল নিয়ে। সারা দেশে ১৪,৫০০ (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বড় জোর শ’পাঁচেক) স্কুলের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র পাঁচ বছর টাকা দেবে। তার পর সব দায়িত্ব, এবং রাজ্যের বাকি ৯৪,০০০ স্কুলের দায়িত্ব, পুরোপুরি রাজ্যের। কৃপাধন্য স্কুলগুলির নামের গোড়ায় থাকবে প্রধানমন্ত্রীর আবাহন। পশ্চিমবঙ্গ এই বিচিত্র শর্ত মানতে অপারগ। তাতে জাতীয় শিক্ষানীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে, এই কষ্টকল্পিত অজুহাতে কেন্দ্র কম্পোজ়িট গ্রান্ট-সহ সমগ্র শিক্ষা অভিযানের সব টাকা, অর্থাৎ স্কুলশিক্ষা বাবদ কেন্দ্রের প্রায় সমস্ত সাহায্য, দেড় বছর আটকে রেখেছে। রাজ্য জুড়ে সরকারপোষিত স্কুলগুলির নাভিশ্বাস।
এই স্বৈরাচারে শিক্ষার অধিকার আইন বিঘ্নিত হচ্ছে কি না, তা আইনজ্ঞেরা বলবেন। আসল অনাচার, রাজনৈতিক প্রচারের সুযোগ ফস্কাবার অভিমানে ছেলেমেয়েদের সুষ্ঠু শিক্ষালাভে বাদ সাধা হচ্ছে। সরকারি শিক্ষানীতির নামে শিক্ষার যথার্থ নীতি শিকেয় উঠছে।
এক কথায়, শিক্ষার যৌথ দায়িত্ব কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকার বিসর্জন দিচ্ছে নিজের নিজের ঢঙে ও স্বার্থে। এক পক্ষ টাকা ঢালছে নানা আনুষঙ্গিক খাতে, আসল শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষয়ে যাচ্ছে অর্থ, পরিকাঠামো ও লোকবলের একান্ত অভাবে। অপর দল কিছুই দিচ্ছে না, বঞ্চনার অস্ত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাত হানছে কেবল। প্রাথমিক থেকে পিএইচ ডি, বিদ্যাভ্যাসের সব উদ্যোগ আষ্টেপৃষ্ঠে লাল ফিতেয় বাঁধা হচ্ছে: গিঁট খুলতে শিক্ষককুল হিমশিম খাচ্ছেন। লেখাপড়া গবেষণা যে আক্রান্ত হচ্ছে তা কর্তাদের কাছে অবান্তর, হয়তো আকাঙ্ক্ষিত। এই ধীর ধ্বংস রাজ্যের অভিভাবককুল মেনে নিচ্ছেন, বা সাধ্যাতীত ব্যয়ে অন্য ব্যবস্থার শরণ নিচ্ছেন ও প্রায়ই ঠকছেন। ছাত্রদের কাছে স্কুল কলেজ আকর্ষণ হারাচ্ছে। পরিবর্তে তারা সোজা বা চোরাপথে অন্যত্র রোজগারের রাস্তা খুঁজছে বা নিছক বসে যাচ্ছে।
সর্বভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান ধারা এমনিতেই এই পরিণতিতে পৌঁছত। বিশ্বগুরুর ঘরের শিষ্যদের আধপেটা শিক্ষা জুটত, অধরা থেকে যেত নলেজ ইকনমির স্বপ্ন। অধিকাংশ তরুণ বড় জোর তালিম পেত গিগ ইকনমির খুচরো কামাইয়ে দিন গুজরান করতে। আক্ষেপ এই, বাংলার ক্ষমতা ছিল রাজ্যস্তরে এই ধারা কিছুটা প্রতিরোধ করার, এমনকি শিক্ষার একটা মরূদ্যান সৃষ্টি করার। বাঙালি সমাজে লেখাপড়ার আজও একটা বিশেষ স্বীকৃতি আছে। মেধার ভান্ডার অফুরন্ত। পঠনপাঠন গবেষণার সংস্কৃতি আজও জীবন্ত। শিল্পপতিদের কাছে মানবসম্পদ নিয়ে আমরা বড়াই করি। অবহেলা আর হুজুগেপনার দৌলতে সে বড়াই অসারহতে বসেছে। আমাদের সহজাত বিদ্যানুরাগ শুকিয়ে যাচ্ছে, নব্য ভারতের ফরমায়েসি বিদ্যার জমিও তৈরি হচ্ছে না।
এখনও কি আমরা পরিস্থিতি উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করব, না অন্য হিসাব মেলাতে গিয়ে অঙ্কটা ঘেঁটেই চলব? বাকি হিসাবগুলোও তবে শেষে মিলবে তো?
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়