ভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে আগেই। খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির অন্তর্গত স্বাস্থ্য-শিক্ষা নীতি ঘিরেও এ বার বিতর্কের ভূমিকা তৈরি হয়ে গেল। উঠল আপত্তি। দেখা দিল আশঙ্কাও।
ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান কে কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বাধীন কমিটির খসড়া শিক্ষানীতিতে স্বাস্থ্য-শিক্ষা নিয়ে যে-সব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে বেশ কিছু বক্তব্য আরও স্পষ্ট করার দাবি উঠেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, এমবিবিএস পাঠ্যক্রমের প্রথম এক বা দু’বছর ‘কমন পিরিয়ড’ হিসেবে ধরা হবে। সেই পর্ব মিটলে ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করবেন, তাঁরা এমবিবিএস নিয়েই পড়বেন, নাকি নার্সিং, ডেন্টাল বা বহুমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্য কোনও বিষয় বেছে নেবেন। একই সঙ্গে খসড়ার প্রস্তাব অনুযায়ী নার্সিং, ডেন্টাল-সহ মেডিক্যালের অন্যান্য শাখার স্নাতকেরাও যদি একটা সময়ের পরে মনে করেন, তাঁরা এমবিবিএস পাঠ্যক্রম পড়বেন, সেই সুযোগ থাকবে। খসড়া প্রস্তাবে যাকে বলা হয়েছে ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্য, নার্সিং, ডেন্টাল-সহ মেডিক্যালের অন্য শাখার ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ পাবেন, সেই বিষয়ে বিশদ কিছু বলা হয়নি। তাঁদের প্রশ্ন, এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে কমন পিরিয়ডের পরে ছাত্রছাত্রীরা তো পছন্দের বিষয় বেছে নেবেন। তা হলে ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’র প্রয়োজন কী! খসড়ার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চিকিৎসকের অপ্রতুলতা নার্সেরা যাতে খানিকটা হলেও মেটাতে পারেন, সেই জন্য চালু করা হবে ‘নার্স প্র্যাক্টিশনার্স’ পাঠ্যক্রম। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা খুব আপত্তিকর। যেখানে চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, সেখানে নার্স দিয়ে কাজ চালানো হবে? এটা কী করে হয়! নার্সেরা তো ডাক্তারি পড়েননি।’’
খসড়া নীতির প্রস্তাব ঘিরে আপত্তির পাশাপাশি আশঙ্কাও রয়েছে। প্রস্তাবে বহুমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে আয়ুর্বেদ, যোগ, ন্যাচারোপ্যাথি, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথিকে (আয়ুষ) ‘মূল স্রোত’-এ আনার কথা বলা হয়েছে। ‘মূল স্রোত’ শব্দবন্ধের তাৎপর্য নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। সুবীরবাবুর বক্তব্য, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রয়োজনমতো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ুষের অন্তর্গত চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, জেলা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইতিমধ্যে এই ধরনের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তা হলে মূল স্রোত শব্দবন্ধ কেন ব্যবহার করা হল, সেটা স্পষ্ট নয়। ‘‘প্রাথমিক, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল নিয়ে সরব হলেও খসড়া প্রস্তাবে মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো এবং গবেষণা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। সেটাও লক্ষণীয়,’’ বলছেন সুবীরবাবু।
কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বাধীন কমিটির স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত খসড়ার বেশ কিছু জায়গায় যে অস্পষ্টতা রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষেরাও। উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘চলতি বছরেই এমসিআইয়ের নির্দেশিকা মেনে পাঠ্যক্রমে বেশ কিছু বদল হয়েছে। সেই নির্দেশিকা বলবৎ করতে শিক্ষক-চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ হয়েছে। পরিকাঠামোগত বদল ঘটেছে। এত দ্রুত আবার পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হলে তো খুব মুশকিল। ডাক্তারির পাঠ নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা না-করাই বাঞ্ছনীয়।’’
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ল্যাটারাল এন্ট্রির ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। নার্স প্র্যাক্টিশনার্সের ধারণা খাতায়-কলমে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নার্সিং কোর্সের তুলনায় অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হয়। ফিনল্যান্ডে রোগীকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করেন নার্স প্র্যাক্টিশনার্সেরাই। তবে আমাদের দেশে এই প্রস্তাব কী ভাবে রূপায়িত হচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। এই নিয়ে নিশ্চয়ই আরও আলোচনা হবে।’’
খসড়ার একটি প্রস্তাবকে সকলেই স্বাগত জানিয়েছেন। তা হল, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিলে এমবিবিএস কোর্সে যে-‘এগজিট এগ্জাম’-এর কথা বলা হয়েছে, সেটিই স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষা হিসেবে গণ্য হবে।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘‘এমবিবিএস কোর্সের কমন পিরিয়ড বা ল্যাটারাল এন্ট্রির প্রস্তাব খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে না। তবে নার্স প্র্যাক্টিশনার্স, আয়ুষ-সহ সব ক’টি বিষয়ে ভাবনাটা কী রকম, সেটা আরও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। এটা তো খসড়া। নিশ্চয় এই নিয়ে আগামী দিনে সবিস্তার আলোচনা হবে।’’