বাঁ দিকে, মোবাইলে স্বজনের ছবি হাতে এক যুবক, ডানদিকে, জওয়ানের স্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র।
কোথায় গেলেন মানুষটা? হাসপাতালে নেই। বাড়িও ফেরেননি। বাঁকুড়ার বৈশাখী ধাড়া মর্গে গিয়েছিলেন কাঁপতে কাঁপতে। না, ওই চেহারার কাউকে দেখেননি। নাকি দেখেছেন? চিনতে পারেননি? তা কী করে সম্ভব? মর্গের অশনাক্ত অসংখ্য মৃতের মধ্যেই তা হলে কি বিকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে? দুমড়েমুচড়ে থাকা কামরাগুলোর মধ্যে পড়ে নেই তো? রবিবার নিরাপত্তারক্ষীদের অনুমোদন ছাড়া কাউকে দুর্ঘটনাস্থলে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিকদেরও নয়। বেশ খানিকটা দূরে বৈশাখী দাঁড়িয়ে ছিলেন অসহায় মুখে। দু’চোখে অশ্রুধারা। এবং দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ভীষণ ক্লান্ত। গলা দিয়ে ঠিকমতো আওয়াজও বার হচ্ছে না আর।
ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন বৈশাখীর স্বামী নিখিল ধাড়া। সিআরপিএফ জওয়ান। ছত্তীসগঢ়ের সুকমায় কর্মরত। ছুটি শেষে ফিরে যাওয়ার আগে ওড়িশায় একটি কাজের জন্য করমণ্ডলে চেপে শুক্রবার রওনা দিয়েছিলেন। তার পরই করমণ্ডলের অঘটন। স্বামীর খবর না পেয়ে বাহানগা পৌঁছে গিয়েছেন বৈশাখী। বললেন, ‘‘থানা থেকে ফোন করে দুর্ঘটনার খবর পাই। এক জন ওর ফোন কুড়িয়ে আমাদের দিয়েছেন।’’ বলার পরই গলা বুজে এল বৈশাখীর। জানি না, শেষ পর্যন্ত নিখিলের খোঁজ তিনি পেয়েছেন কি না!
শুধু বৈশাখী নন, এমনই দিশেহারা অবস্থায় আরও অনেকে। কেউ প্রিয়জনের ছবি হাতে নিয়ে হন্যে হয়ে এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছেন। ছোটাছুটি করছেন মর্গে। মৃতদেহের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে কারও চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। দুর্ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় পরও মৃতদেহ চিহ্নিত করা এবং আপনজনের সন্ধান চালাতে গিয়ে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তার পর ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরেছে, ততই সাদা কাপড়ে ঢাকা থরে থরে মৃতদেহের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি, প্রিয়জনদের খোঁজও শুরু হয়েছে। রবিবার দিনভর বালেশ্বরে এই ছবি ধরা পড়েছে। এক দিকে, বাহানগা বাজারে দুর্ঘটনাস্থলে রেললাইন সারিয়ে নতুন করে ট্রেন চালাতে দিনরাত এক করে কাজ করছেন রেলকর্মীরা। আর অপর দিকে, আপনজনদের খোঁজ পেতে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখা গেল বেশ কয়েক জন মানুষকে।
বেঙ্গালুরু থেকে ‘যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে’ (এখন নাম বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস) বাড়ি ফিরছিলেন জলপাইগুড়ির নাগরাকাটার বাসিন্দা সাগর খরিয়া। হাইটেক শহরের হোটেলে ওয়েটারের কাজ করেন। ১৪ জনে মিলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু খোঁজ নেই সাগরের। দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে গিয়েছে সাগরের দুই বন্ধু মুন্না বারিক এবং ধর্মেন্দ্র সিংহের। সেই অবস্থাতেই, নিজেদের শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সাগরের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তাঁরা।
টেবিলে রাখা হয়েছে মৃতদেহের ছবি। —নিজস্ব চিত্র।
খোঁজ নেই উত্তর দিনাজপুরের আনজারুল হকেরও। রাজমিস্ত্রির কাজ সেরে বেঙ্গালুরু থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। আনজারুলের খোঁজে বালেশ্বর হাসপাতালে ঘুরতে দেখা গেল তাঁর স্বজনদের। রাজমিস্ত্রির কাজে করমণ্ডলে চড়ে চেন্নাই যাচ্ছিলেন বীরভূমের ২২ বছরের যুবক অমর মুদি। তাঁরও খোঁজ নেই। করমণ্ডলে চেপে সেকেন্দ্রাবাদ যাচ্ছিলেন বিহারের বাসিন্দা ইন্দ্র দেও রাউত। তাঁরও হদিস নেই। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তাঁর আত্মীয় শৈলেন্দ্র পটেল।
করমণ্ডল দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রেল (যদিও ওড়িশা সরকারের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৭৫)। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে কারও কারও শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক। ২৮৮ জন মৃতের মধ্যে অধিকাংশকেই শনাক্ত করা যায়নি রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।