মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাহুল গান্ধী। —পিটিআই।
বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে লোকসভা ভোটের আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে সময় বেঁধে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার শাসকদল তৃণমূলের তরফে মঙ্গলবারের বৈঠকে সরাসরি বলা হয়, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজ্যওয়াড়ি আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে হবে।
‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে মমতার ওই প্রস্তাবের পরেই বাংলার কংগ্রেস নেতৃত্বকে দ্রুত দিল্লিতে তলব করেছে কংগ্রেস হাইকমান্ড। সূত্রের খবর, সেখানেই বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের মতামত শুনবে হাইকমান্ড। তার পরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হবে।
প্রদেশ কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, প্রাথমিক ভাবে ছ’টি আসন চেয়ে কথা শুরু করবে কংগ্রেস। বহরমপুর এবং মালদহ দক্ষিণের দু’টি জেতা আসনের পাশাপাশি তারা মালদহ উত্তর, রায়গঞ্জ, পুরুলিয়া এবং দার্জিলিং আসনও দাবি করতে পারে। এর প্রতিটিই বিজেপির জেতা। ফলে কংগ্রেসের আশা, মমতা তা মেনে নিলেও নিতে পারেন। তবে মমতা তা মানবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। cম
মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার, মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় —পিটিআই।
প্রসঙ্গত, কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যেই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে প্রাথমিক কথা হয়ে রয়েছে মমতার। সেখানে কথা হয়েছে বহরমপুর, মালদহ দক্ষিণ এবং রায়গঞ্জ আসন তিনটি নিয়ে। তৃণমূলের একাধিক সূত্রের মতে, বাংলায় আসন সমঝোতা দ্রুত সেরে ফেলার জন্য কংগ্রেসের উপর খানিকটা ‘চাপ’ তৈরির কৌশলও নিচ্ছে তৃণমূল। বাংলার শাসকদলের তরফে বার বারই বোঝানো হচ্ছে, তারা দ্রুত আসন সমঝোতা সেরে ভোটের প্রস্তুতি শুরু করতে চায়। অনেকের মতে, সেই কারণেই বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থাকেননি।
সময় বেঁধে আসন সমঝোতার বিষয়ে তৃণমূলের প্রস্তাব সমর্থন করেছে সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি, আরজেডি-সহ আরও বেশ কয়েকটি দল। যদিও আগামী ১২ দিনের মধ্যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কোহিমা সেই কাজ করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তবে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ, কেসি বেণুগোপালরা দাবি করেছেন, আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। কোনও সমস্যা হবে না। তবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই যে তা সম্পন্ন হবে, তা তাঁরা উল্লেখ করেননি।
‘ইন্ডিয়া’ সূত্রের খবর, বৈঠকে কংগ্রেসকে ৩০০টি আসনে লড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাকি ২৪৩টি আসন শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মমতা বলেছেন, যে যে রাজ্যে শক্তিশালী, আসন সমঝোতার নিয়ন্ত্রণ সেখানে সেই দলের হাতেই থাকুক। এই সূত্র কংগ্রেসের মেনে নেওয়া উচিত। কংগ্রেস যেন শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে ‘উদার মনোভাব’ নিয়ে এগোয়। অর্থাৎ, মমতা বলতে চেয়েছেন বাংলায় আসন সমঝোতার নিয়ন্ত্রণ কংগ্রেস যেন তৃণমূলের হাতে ছেড়ে দেয়।
মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’র আগের বৈঠকেই তৃণমূল দাবি জানিয়েছিল, অক্টোবরের মধ্যে লোকসভার আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করা হোক। কিন্তু পাঁচ রাজ্যের ভোটের কথা মাথায় রেখে কংগ্রেস সে পথে হাঁটেনি। অনেকেই সেই সময় বলেছিলেন, কংগ্রেস পাঁচ রাজ্যে ভোটের ফলাফল দেখে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতির দিকে এগোতে চাইছে। কিন্তু গত ৩ ডিসেম্বর ভোটের ফলপ্রকাশের পর দেখা যায়, কংগ্রেস হিন্দি বলয়ে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের হাতে থাকা ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থান দখল করে নিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেসের সান্ত্বনা পুরস্কার বলতে কেবল তেলঙ্গানা। কংগ্রেসের এ হেন অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই আসন সমঝোতা নিয়ে ‘চাপ’ বাড়িয়েছে আঞ্চলিক দলগুলি। ফলে কংগ্রেসের কাছেও ‘নমনীয়’ হওয়া ছাড়া বিকল্প পথ বিশেষ নেই।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক শুরুর আগেই কংগ্রেসের তরফে আসন সমঝোতা সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করা হয়। যেখানে রাখা হয়েছে রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ের দুই সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত ও ভূপেশ বাঘেল-সহ পাঁচ জনকে। অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের আগে মমতার সঙ্গে পৃথক ভাবে কথা বলেন সপা নেতা তথা উত্তরপ্রদেশের বিরোধী দলনেতা অখিলেশ যাদব। সূত্রের খবর, বৈঠকে পাঁচ রাজ্যের ভোটে কংগ্রেসের ‘অনমনীয়’ মনোভাব নিয়ে সরব হন অখিলেশ। যা পরে স্বীকার করে নেন বেণুগোপালও। তিনি বলেন, ‘‘সমালোচনা, আত্মসমালোচনা সবই হয়েছে। আমাদের কাজ এখন দেশ বাঁচানো। তার জন্য আগে আসন সমঝোতার কাজ সেরে ফেলতে হবে।’’
বিরোধী পক্ষের প্রধানমন্ত্রীর ‘মুখ’ কে? এত দিন পর্যন্ত মমতা থেকে বিরোধী নেতারা বলতেন, ভোটের পর তা ঠিক হবে। সোমবারও মমতা সেই কথা বলেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে সেই মমতাই যেন ‘চমক’ দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘মুখ’ হিসেবে সরাসরি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের নাম প্রস্তাব করেন মমতা। তাঁকে সমর্থন করেন এমনিতে কংগ্রেসের বিরোধী হিসেবে পরিচিত আম আদমি পার্টির প্রধান তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল। যদিও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু হয়নি মঙ্গলবারের বৈঠক থেকে। প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকালে মমতার সঙ্গে দেখা করেন শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে। তিনিই জানান, জোটের এক জন ‘মুখ’ থাকা দরকার। উদ্ধব বলেন, ‘‘রথের ঘোড়া হিসেবে ২৭টি দল রয়েছে। কিন্তু এক জন সারথি প্রয়োজন।’’ সেই সূত্রেই জোটের ‘মুখ’-এর প্রসঙ্গ ওঠে বৈঠকে। ঠিক ‘মুখ’ না-বললেও উদ্ধব বৈঠকে ঘোষিত ভাবে ‘আহ্বায়ক’ রাখার কথা বলেন।
‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক। —পিটিআই।
সূত্রের খবর, মমতা তখন বলেন, খড়্গে অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি অনগ্রসর শ্রেণি থেকে উঠে আসা। একদা লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। এখন রাজ্যসভায় কংগ্রেসের নেতা। তাই তাঁকেই ‘মুখ’ করে লোকসভা ভোটের লড়াইয়ে নামা হোক। মমতাকে সমর্থন করেন কেজরীওয়াল। যদিও খড়্গে তাতে রাজি হননি। বৈঠকে তিনি বলেন, আগে জোট জিতুক। তার পরে দেখা যাবে। তবে তিনি কিছু চান না। তিনি গরিব মানুষের স্বার্থে কাজ করতে এসেছেন। আগেভাগে এ সব করার কোনও দরকার নেই। বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের সামনে বিবৃতি দেওয়ার সময়েও খড়্গে বলেন, ‘‘না জিতলে প্রধানমন্ত্রী মুখ নিয়ে আলোচনা করারও দরকার হবে না। ফলে আগে আমাদের জিততে হবে। তার পরে এ সব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’’ অনেকেই অবশ্য বলছেন, মমতা যে ভাবে রাহুল গান্ধীর নাম ‘মুখ’ হিসেবে প্রস্তাব না করে খড়্গের নাম করেছেন, তা রাজনৈতিক ভাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
সূত্রের খবর, মঙ্গলবারের বৈঠকে আরও একটি বিষয় ঠিক হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে ‘ইন্ডিয়া’র তরফে দাবি জানানো হবে, লোকসভা ভোটে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের সঙ্গেই ১০০ শতাংশ বুথে ভিভিপ্যাট-ও রাখা হোক।
খড়্গে পরে জানান, বৈঠকে ঠিক হয়েছে, সংসদে গণ সাসপেনশন নিয়ে আগামী ২২ ডিসেম্বর, শুক্রবার রাজ্যে রাজ্যে যৌথ কর্মসূচি করবে ‘ইন্ডিয়া’। তবে তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকে বৈঠকে জানিয়েছে, ওই দিন তাদের রাজ্যের ‘প্রতিষ্ঠা দিবস’। তা ছাড়া রাজ্যের বহু এলাকা বন্যাকবলিত। তাই তামিলভূমে ওই কর্মসূচি পরে কোনও এক দিন হবে। তবে আসল কৌতূহল হল, শুক্রবার কি সব রাজ্যেই ‘যৌথ কর্মসূচি’ দেখা যাবে? মঙ্গলবারের বৈঠকে যে ভাবে পাশাপাশি বসেছিলেন মমতা, রাহুল এবং সীতারাম ইয়েচুরি, সে ভাবেই কি ওই দিন কলকাতায় মমতা, অধীর চৌধুরী ও মহম্মদ সেলিম পাশাপাশি থেকে কর্মসূচি করবেন? ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম নেতারা অবশ্য স্পষ্টই বলছেন, বাংলায় সেই সম্ভাবনা নেই।