ফাইল চিত্র।
আমেরিকার সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর বার্তা স্পষ্ট। রাশিয়া প্রশ্নে ভারত-আমেরিকার মতৈক্যের কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই। কিন্তু সেই মতবিরোধ যাতে সম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সম্পর্কে ছায়া না ফেলে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে দু’পক্ষই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শীর্ষ বৈঠক এবং ‘টু প্লাস টু’ আলোচনার পর এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
এই বৈঠকের কিছু দিন আগেই বাইডেন বলেছিলেন, কোয়াডভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থান ‘নড়বড়ে’ লাগছে। কিন্তু মোদী-বাইডেন বৈঠকে আমেরিকার স্বর যথেষ্ট নরম দেখা গিয়েছে। এমনকি আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও ভারত-রাশিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট সহনশীলতা দেখিয়ে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের সামনে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “মস্কো এবং দিল্লির সম্পর্ক যখন গড়ে ওঠে তখন আমেরিকার থাকা সম্ভব ছিল না।’’ ভারতের বিপুল বাজারের জ্বালানির চাহিদা নিয়েও আংশিক সংবেদনশীলতার ছাপ পাওয়া গিয়েছে আমেরিকার কণ্ঠে।
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, গোটা বিষয়টিই দেনাপাওনার। রাশিয়া প্রশ্নে ভারতকে নিজের শিবিরে আনার চেষ্টা আমেরিকা বন্ধ করে দেবে, বা ভারতের প্রতি নরম হয়ে এই নিয়ে চাপ কমিয়ে ফেলবে—এমন নয়। কিন্তু ভারত এবং আমেরিকার ভিতর রাশিয়া নিয়ে যে ‘পজ়’ বোতামটি টেপা হল, ওয়াশিংটনের দিক থেকে তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মুহূর্তের ভূকৌশলগত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী রাশিয়া নয়, আমেরিকার মূল শত্রু চিন। গোটা অঞ্চলে চিনকে ধারাবাহিক ভাবে চাপে রাখতে, ভারতের মতো একটি দেশকে বাইডেন প্রশাসনের প্রয়োজন। ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে বেজিংয়ের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করার জন্যই আমেরিকার কোয়াড-এর আয়োজন। সেই কোয়াড বা চতুর্দেশীয় গোষ্ঠীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভারত। ফলে রাশিয়ার কারণে ভারতকে ব্রাত্য করা এখন কৌশলগত ভাবে সম্ভব
নয় আমেরিকার।
পাশাপাশি, রাশিয়ায় ভারতের কিছুটা হলেও (চিনের তুলনায় অনেক কম) প্রভাব রয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে দর কষাকষি করতে ভারতকে ব্যবহার করা যে আমেরিকার উদ্দেশ্য, সে কথা ব্লিঙ্কেন স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন সাংবাদিক সম্মেলনে।
অন্য দিকে ভারতের দিক থেকেও মতবিরোধকে জিইয়ে রেখেই সম্পর্কের অন্য দিকগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কথায়, “বিশ্বে কী কী ঘটে চলেছে, সে দিকে নজর দিলে দেখা যাবে আমরা প্রত্যেকটি দেশই নিজের মতো করে তার বিচার করি এবং উপসংহারে পৌঁছই। আমাদের খুব ভাল ধারণা আছে নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে এবং তাকে সুরক্ষিত রেখে কী ভাবে এগিয়ে যেতে হয়, সেটাও আমরা জানি। এখন সামনে অনেকগুলি বাছাইয়ের সুযোগও রয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “এখন আমরা টু প্লাস টু–র মঞ্চে দাঁড়িয়ে রয়েছি। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গত এক দশকে যথেষ্ট সমন্বয় ঘটেছে দু’দেশের মধ্যে। আমরা তাকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। চল্লিশ বছর আগে এই সুযোগটাই ছিল না। বিশ্ব বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের কাজ হল, এরই মধ্যে নিজ নিজ স্বার্থ কী ভাবে চরিতার্থ করা যাবে, তার সন্ধান করা।”
ইউক্রেনের বাইরে যে বিস্তীর্ণ বিষয় রয়েছে, সেগুলি বিশদে উঠে এসেছে ভারত-আমেরিকা যৌথ বিবৃতিতে। যার মধ্যে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো, কোভিড পরবর্তী বিশ্বে সহযোগিতা দৃঢ় করা, প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনকে রুখতে নতুন কৌশল রচনার মতো বিষয়। ব্লিঙ্কেনের কথায়, “চিন এমন ভাবে গোটা অঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে যাতে শুধুমাত্র তাদেরই লাভ হয়।”
অন্য দিকে হোয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে এক আলোচনাচক্রে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, “ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গত দু’দশক ধরে প্রকৃত অর্থেই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। কৌশলগত, বাণিজ্যিক, প্রযুক্তিগত অথবা নিরাপত্তা ক্ষেত্র— যে কোনও বিষয়েই আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ওজন বিশ্ব-ব্যবস্থা টের পাচ্ছে।”