গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়কে নকলনবিশি করেছেন। কল্যাণ ঠিক না ভুল করেছেন, সাংসদ হিসাবে তাঁর ওই আচরণের ঔচিত্যের প্রশ্নে পুরো কাণ্ডের মধ্যে জড়িয়ে গেলেন রাহুল গান্ধী এবং তাঁর দল কংগ্রেস। কল্যাণের ভিডিয়ো করে বিজেপির তোপে রাহুল আগেই পড়েছেন। এ বার নাম না করে রাহুলকেই ‘দোষী’ ঠাওরালেন ধনখড়। বস্তুত, কল্যাণের মিমিক্রির চেয়ে রাহুলের ভিডিয়ো করার বিষয়টির সমালোচনা হচ্ছে বেশি। এ নিয়ে রাজ্যসভায় ধনখড়ের প্রশ্নের মুখে পড়ল কংগ্রেস। ধনখড়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গের অভিযোগ, তাঁকে জাতিবিদ্বেষমূক আক্রমণ করা হচ্ছে। অন্য দিকে, কল্যাণকাণ্ডে তাঁর দলের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কল্যাণ হালকা চালে ব্যাপারটা করেছেন। আর সেখানে তো রাহুল গান্ধীর মতো নেতাও ছিলেন। এখন তৃণমূল সাংসদের ‘মিমিক্রি শিল্প’ (কল্যাণ নিজে বলেছেন) নিয়ে দেশের শাসকদল থেকে উপরাষ্ট্রপতি, লোকসভার অধ্যক্ষ থেকে রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের সমালোচনার মুখে পড়ল কংগ্রেস।
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার সকালে। গত ১৩ ডিসেম্বর লোকসভায় হানা নিয়ে আলোচনার দাবি করেছিল বিরোধীরা। কিন্তু হয়নি। তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিবৃতি দাবি করে সংসদে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে অবস্থানে বসেছিলেন বিরোধী সাংসদেরা। সেখানে শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণকে দেখা যায় উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের বাচনভঙ্গি নকল করতে। হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলেন অন্য বিরোধী সাংসদেরা। সাদা টি-শার্ট, অফ হোয়াইট ট্রাউজার্স পরিহিত রাহুলকে দেখা যায় কল্যাণের ওই নকলনবিশি তিনি মোবাইলে রেকর্ড করছেন। প্রথমে ওই গোটা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ধনখড় তিনটি শব্দ বলেছিলেন— ‘লজ্জাজনক, হাস্যকর, অপ্রীতিকর’। তার একটু পরে ধনখড় আরও বিস্তারিত ভাবে নিজের খারাপ লাগার কথা বলতে থাকেন। এবং বুধবার তিনি জানিয়েছেন গোটা ঘটনায় তিনি অপমানিত। তবে উল্লেখযোগ্য ভাবে ধনখড় যত না কল্যাণকে নিয়ে বলেছেন, তার চেয়ে বেশি অনুযোগ করেছেন রাহুলকে নিয়ে।
মঙ্গলবারই কল্যাণের ওই নকলনবিশির দৃশ্য ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজমাধ্যমে। ঠিক তত দ্রুত রাহুলের সমালোচনা শুরু করে গেরুয়া শিবির। বিজেপি তাদের এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ধনখড়কে নকল করা কল্যাণ এবং হাসতে হাসতে সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে রাখা রাহুলের ভিডিয়ো শেয়ার করে লেখে, ‘‘দেশের মানুষ যদি ভাবেন, কেন বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হল, তার উত্তর খুঁজে পাবেন এখানেই। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মাননীয় উপরাষ্ট্রপতিকে উপহাস করছেন। আর রাহুল গান্ধী তাঁকে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এঁরা সংসদের ভিতরে কতটা বেপরোয়া এবং নিয়মভঙ্গকারী।’’
গোটা ঘটনায় অসন্তুষ্ট ধনখড় মঙ্গলবার মুলতুবির পর রাজ্যসভার অধিবেশন শুরু হতেই এক কংগ্রেস নেতাকে সম্বোধন করে ধনখড় বলেন, “কিছু ক্ষণ আগে একটি টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম... কেউ এতটা নীচে নামতে পারে! কোনও সীমা নেই?’’ রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের সংযোজন, ‘‘আপনাদের সিনিয়র নেতাকে দেখলাম অসংসদীয় কাজের ভিডিয়ো শুট করতে। আমি শুধু এটাই বলতে চাই, ওঁদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।”
কিন্তু কল্যাণকাণ্ড এখানেই থমকে থাকেনি। বরং বুধবার গড়গড় করে তা আরও গড়িয়েছে। কল্যাণের কাণ্ডে ‘ব্যথিত’ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ওই ঘটনার সমালোচনা করেছেন। ধনখড় নিজে জানান, তাঁকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কল্যাণকাণ্ডে তিনিও দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এমনকি, এ-ও বলেছেন, বিগত ২০ বছর এমন অনেক অপমান তিনিও সয়েছেন। ঘটনাক্রমে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করে কল্যাণকাণ্ডের নিন্দা করেন। পাশাপাশি তিনিও ওই ভিডিয়ো করার জন্য রাহুলের সমালোচনা করেন।
বুধবার রাজ্যসভায় আবারও তাঁকে নকল করার প্রসঙ্গ তুলে ধনখড় বলেন, ব্যক্তিমানুষ হিসাবে তাঁকে নকল করলে যেত-আসত না। কিন্তু উপরাষ্ট্রপতির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এমন কোনও কিছুই তিনি সহ্য করবেন না। এর পর কংগ্রেস সাংসদ দিগ্বিজয় সিংহকে সোজাসুজি তাঁদের ‘নীরবতার কারণ’ জানতে চান ধনখড়। সেখানেও তৃণমূল বা তৃণমূল সাংসদের চেয়েও রাহুলের ভিডিয়ো করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। দিগ্বিজয়কে ধনখড় বলেন, ‘‘আপনারা বলেন যে আপনাদের দল নাকি ১৩৮ বছর পুরনো। কিন্তু আপনাদের এই নীরবতা আমার কানে বাজছে।’’ কিছুটা মেজাজ হারিয়ে ধনখড় আরও বলেন, ‘‘এক জন ভিডিয়ো করতে করতে মজা করছেন, উৎসাহ যোগাচ্ছেন। এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?’’
এ দিকে সংশ্লিষ্ট বিতর্কের মাঝে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন রাহুল নিজে। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলেন, ‘‘সাংসদরা বসেছিলেন। আমি ভিডিয়ো করছিলাম। ভিডিয়ো আমার ফোনে আছে। এখন সংবাদমাধ্যম এ সব দেখাচ্ছে... কেউ তো কিছু বলেনি... ১৫০ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ নিয়ে তো সংবাদমাধ্যম আলোচনা করছে না। আদানি নিয়ে আলোচনা নেই, রাফাল নিয়ে কথা নেই। বেকারত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। আমাদের সাংসদরা ব্যথিত। তাঁরা বাইরে বসেছিলেন। আর এখন আপনারা পড়েছেন মিমিক্রি নিয়ে।’’