কোন তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, কোন তেলের ধূমাঙ্ক বেশি? ছবি: সংগৃহীত।
‘নিজের চরকা’ ছাড়া অন্য কোথাও তেল দেওয়ার ব্যাপারে মানুষ এখন বেশ সাবধানি।
শরীরের কথা ভেবে আজকাল বেশি তেলে রান্নাও করা যায় না। গেরস্থ বাড়িতে প্রতি দিনের রান্নার জন্য সর্ষের তেলই ব্যবহার হয়। আগেও তা-ই হত। প্রতি মাসে মুদি দোকানের জন্য যে ফর্দ তৈরি হয়, তার মধ্যে সর্ষের তেলের পরিমাণ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি থাকে। লুচি, পরোটা ভাজার জন্য আগে বনস্পতি বা ডালডা ব্যবহার করা হলেও এখন শরীরের কথা ভেবেই ‘সাদা তেল’ খাওয়া হয়। অনলাইনে তেল কিনতে গিয়ে নানা রকম তেলের বিজ্ঞাপন দেখতে পান। ‘গুগ্ল বাবা’ কখনও ঝাঁজযুক্ত, কখনও ‘কোল্ড প্রেস’, কখনও আবার ‘এক্সট্রা ভার্জিন’ তেল খাওয়ার পরামর্শ দেয়।
অনেকে বলেন, হার্টের জন্য অলিভ অয়েল ভাল। আবার দক্ষিণে নারকেল তেল খাওয়ার চল রয়েছে। তাই অনেকের ধারণা, এই এত রকম তেলের মধ্যে সেটিই নাকি উৎকৃষ্ট। মোদ্দা কথা হল, তেল খাওয়া নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে ‘তেল’ খলনায়ক হল কবে থেকে?
সব না হলেও তেলমশলা দেওয়া রগরগে খাবার খাওয়ার চল অনেক বাড়িতেই রয়েছে। তবে যে দিন থেকে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছে, মোটামুটি সে দিন থেকেই সাধারণ মানুষের চোখে ‘ভিলেন’-এর চরিত্রে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ক্রমে দোকান থেকে চপ, শিঙাড়া কেনার আগে তা পোড়া তেলে ভাজা কি না যাচাই করে নিতে শিখেছে আমজনতা। তা সত্ত্বেও হার্টের রোগ, ডায়াবিটিস, হজমের সমস্যা, স্থূলত্ব, চুল পড়ে যাওয়া, মুখে ব্রণের আধিক্য— প্রায় সব রোগের জন্যই তেলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়া যেন দস্তুর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিদদের মতামত কী? শুনল আনন্দবাজার অনলাইন।
রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, হার্ট ব্লক কিংবা উচ্চ রক্তচাপ— এ সব রোগের নাম শুনলে এখন চোখ বন্ধ করে যে কেউ বলে দিতে পারেন, “রান্নায় তেলমশলা বেশি খাওয়া হয় বোধ হয়।” সাধারণ মানুষের মনে এমন একটা ধারণা অদ্ভুত ভাবে গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা ততটা ‘জলবৎতরলং’ নয়। এ প্রসঙ্গে বেশির ভাগ চিকিৎসকের মত, তেলের মান বা ধরনের চেয়েও পরিমাণের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। হৃদ্রোগ চিকিৎসক রাজা নাগ বলেন, “হার্টের অসুখের জন্য শুধু তেলকে দোষ দেওয়া যায় না। সর্ষের তেলের বদলে অলিভ অয়েল খেলে যে সমস্যা হবে না, এমনটা কোথাও লেখা নেই। তেল নিয়ে যদি কোনও সতর্কতা থাকে, তা হলে সেটা পরিমাণের উপর। মোদ্দা কথা হল, যে ধরনের তেলই খান, তার পরিমাণ কমাতে হবে।”
সর্ষের তেলের চেয়ে অলিভ অয়েল যে ভাল, সে কথা ভুল নয়। কিন্তু রাঁধার জন্য ভাল কি না, সেখানে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। অলিভ অয়েলের আধিক্য সাধারণত ইটালীয় খাবারেই বেশি দেখা যায়। কিন্তু মুশকিলের কথা হল, ইটালিতে তো ভাজাভুজি খাওয়ার চল নেই। এখন অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যকর বলে তা দিয়ে যদি কেউ লুচি ভাজতে চান, তা হলে বিপদ। কারণ, সর্ষের তেল বা সূর্যমুখীর তেলের যে ধূমাঙ্ক, তার চেয়ে অলিভ অয়েলের ধূমাঙ্ক অনেক কম। তাই অলিভ অয়েল খুব গরম করলে বা পুড়ে গেলে উল্টে বিপদ বেশি। ঠিক যেমন পোড়া তেলে রান্না করা খাবার শরীরের জন্য বিপজ্জনক। এ বিষয়ে ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ (এফএসএসএআই)-র পরামর্শ, কোনও তেলই তিন বারের বেশি গরম করা উচিত নয়। তা করলেই ‘ট্রান্স ফ্যাট’ তৈরির আশঙ্কা থাকে। বার বার একই তেল গরম করলে তেলের মধ্যে উপস্থিত ফ্যাটের কণা ভেঙে যায়। তা থেকেই তৈরি হয় বিষাক্ত কিছু পদার্থ, যা ক্যানসারের মতো আরও অনেক মারণরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে।
একেবারে সহজ হিসাব। অতিরিক্ত তেল মানেই বেশি ক্যালোরি। সেই ক্যালোরি ক্ষয় না হলেই শরীরে মেদের পরিমাণ বাড়বে। সেখান থেকেই শরীরের যাবতীয় সমস্যার শুরু। সে যে ধরনের বা যত খাঁটি তেলই খাওয়া হোক না কেন, তাতে খুব বেশি হেরফের হওয়ার কথা নয়। তবে প্রতি দিন রাঁধার জন্য কী ধরনের তেল ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করবে কী রাঁধছেন তার উপর। তেমনটাই মত পুষ্টিবিদ এবং যাপন সহায়ক অনন্যা ভৌমিকের। তাঁর বক্তব্য, “বাজারে নানা ধরনের তেল পাওয়া যায়। তবে সাধারণ বাঙালি রান্নার ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণে সর্ষের তেল খাওয়াই ভাল। কারণ, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, প্রদাহনাশক এবং অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল উপাদান রয়েছে সর্ষের তেলে।”
শারীরবৃত্তীয় নানা ধরনের কাজকর্ম সঠিক ভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করে হরমোনের উপর। সে মনমেজাজ বিগড়ে যাওয়াই হোক বা বেশি খেয়ে ফেলার প্রবণতা— সবই হরমোনের হেরফেরে ঘটে যেতে পারে। হরমোনের মাত্রা হেরফের হলেই শরীরের ভিত খানিকটা হলেও নড়ে যেতে পারে। হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্রজনন সংক্রান্ত হরমোনের সঙ্গে তেলের পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। হরমোন সংক্রান্ত নানা ধরনের রোগ রয়েছে। তা বশে রাখতে গেলে তেলের ধরন নয়, নজর দিতে হবে পরিমাণের উপর।”
তেলের সঙ্গে যোগ রয়েছে স্থূলত্বের। আর প্রজনন বা সন্তানধারণ সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অতিরিক্ত ওজনের যোগ রয়েছে। তবে তার জন্য রোজের ব্যবহৃত রান্নার তেল বদলে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে করেন না স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব দত্ত। তিনি জানান, “দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। যার ফলে পলিস্টিটিক ওভারি বা জরায়ু সংক্রান্ত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই তেল খাওয়ার পরিমাণে রাশ টানতেই হবে।”
তেলে-জলে চুল ভাল হয়। ত্বকের জেল্লাও বৃদ্ধি পায় তেল মাখলে। কিন্তু বেশি তেল খেলে ফল হয় উল্টো। চর্মরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, “অনেকেরই ত্বক তৈলাক্ত। তার উপর বেশি তেল খেলে ত্বকের গ্রন্থিতে আরও বেশি করে তেল বা সেবাম তৈরি হয়। ফলে ব্রণের আধিক্য বাড়ে।” আজকাল ত্বকের যত্নে কোরিয়ান প্রসাধনীর ব্যবহার বেড়েছে। তবে কোরিয়ানদের কাচের মত স্বচ্ছ ত্বকের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওঁদের ডায়েটে। অনিরুদ্ধ বলেন, “কোরিয়ানরা তেল, মশলা, চিনি আর দুধ খান না। আমাদের ডায়েট থেকে তা হয়তো পুরোপুরি বাদ দেওয়া যাবে না। অলিভ অয়েলের দাম বেশি। পরিবর্তে সর্ষে বা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তেল খাওয়ার পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।”