প্রতীকী ছবি।
এ মাসের গোড়ায় করোনা হয়েছিল বছর তিরিশের দিশা ঘোষের। দিন সাতেকের মাথায় ‘নেগেটিভ’ রিপোর্টও চলে আসে। তবু দিশা সুস্থ নন। বরং এখনও প্রতি সন্ধ্যায় জ্বর আসছে।
বছর পঁচিশের সায়ন্তনী বিশ্বাসেরও এক হাল। করোনা ছেড়েছে। কিন্তু মাথাব্যথা সারেনি। করোনা সারার সপ্তাহ পাঁচেক পরও মাথাব্যথা থাকছে নিয়মিত।
চল্লিশ ছঁই ছুঁই পৌলমী বসুর আবার করোনার সময়ে যত না বেশি শরীর খারাপ হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এখন। করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর থেকে পিঠ আর হাঁটুতে ব্যথা।
তবে কি একেই বলে লং কোভিড? কিন্তু এ সমস্যা তো আছে অনেকেরই। যাঁদের কোভিড হয়নি, এমনও অনেকে একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
সঙ্কট এখানেই। কার কোভিড হয়েছে আর কার হয়নি, এ স্ফীতিতে যেন তা ঘিরে ধোঁয়াশা বেড়েছে। অনেকেরই হালকা জ্বর, সর্দি কিংবা গা ব্যথা হয়েছে। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা এতই সামান্য যে পরীক্ষা করানোর কথা মনেও আসেনি। কিন্তু এখন তাঁদেরও অনেকের নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে। একে লং কোভিড কিংবা পোস্ট কোভিডের উপসর্গই বলছেন চিকিৎসকরা। দেশ এবং বিদেশের নানা জায়গার চিকিৎসকরা দেখেছেন, কোভিডের এই স্ফীতিতেও প্রথম দু’টি তরঙ্গের মতো রোগীরা সেরে ওঠার পর নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু এ বার যেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই সব সমস্যা নিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে খানিক বেশি।
এর পিছনে মূলত দু’টি কারণ দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। একটি হল, গত বারের তুলনায় বেশি সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। করোনার নতুন রূপ, ওমিক্রন খুবই ছোঁয়াচে। ফলে দ্রুত ছড়িয়েছে। আর একটি কারণ হল, এ বার করোনা পরবর্তী শারীরিক অসুস্থতাও যেন রূপ বদলেছে। রকমারি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সে সব যে করোনারই প্রভাব, বুঝতেই বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে সারতে দেরি হচ্ছে।
চিকিৎসক অদ্রিজা রহমান মুখোপাধ্যায় গত দু’বছর ধরেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য, এ বারের সমস্যা কিছুটা অন্য রকম। এ বার কোভিড পরবর্তী এমন কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যা রোগী এবং চিকিৎসকদের বিভ্রান্ত করছে। যেমন অদ্রিজা বলেন, ‘‘এ বার শুধু পোস্ট-কোভিড নয়, কোভিডের উপসর্গেও অনেক বৈচিত্র দেখা গিয়েছে। কেউ কাশি-গলা ব্যথা নিয়ে আসছেন, তো কেউ কোমরে ব্যথা, পিঠ ব্যথা নিয়ে আসছেন। কারও বা আবার শুধুই পেটের গোলমাল। কেউ কেউ বলছেন ম্যালেরিয়ার মতো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। এত রকমের উপসর্গের কথা সকলে জানেন না। আগের বার পর্যন্ত সর্দি, জ্বর, শ্বাসের সমস্যা হচ্ছিল। সকলে চিনতেও পারছিলেন করোনার উপসর্গগুলি। এখন করোনার জন্যই যে নতুন সব সমস্যা হচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন না অনেকে। তাই পরীক্ষাই হয়তো করিয়ে উঠছেন না। আর পরীক্ষা না করালে জানা যাচ্ছে না যে করোনা হয়েছে। তার পরবর্তী কোনও উপসর্গ দেখা দিলে তখন চিকিৎসা করাতেই সমস্যায় পড়তে হয়।’’ অদ্রিজার পরামর্শ, এ সময়ে কোনও সমস্যাই উপেক্ষা করা চলবে না। যে কোনও ধরনের উপসর্গ দেখা দিলেই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। কারণ করোনা পরবর্তী যে লং কোভিডের নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে, তা-ও রূপ বদলেছে। কারও করোনার পর ডায়াবিটিস দেখা দিচ্ছে, কারও ড্রাই আইজের সমস্যা হচ্ছে। কেউ কেউ ভুগতে শুরু করছেন রিউম্যাটিক আর্থরাইটিসে। কারও আবার কাশি সারছেই না। অদ্রিজা বলেন, ‘‘এই সব ক’টি সমস্যা এমনিতে দেখা দিলে তার চিকিৎসা এক ভাবে হয়। করোনার প্রভাবে দেখা দিলে অন্য পন্থা নিতে হতে পারে। কিন্তু এ সব যখন দেখা দিচ্ছে, তখন আর শরীরে ভাইরাস থাকছে না। ফলে সে সময়ে পরীক্ষা করিয়ে লাভ হয় না।’’ তাই অদ্রিজার পরামর্শ, সাধারণ কোনও উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্র করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
প্রতীকী ছবি।
পাশাপাশি অদ্রিজার আরও বক্তব্য, সরকার সংক্রমিত হওয়ার সাত দিনের মাথায় সকলের সঙ্গে মেলামেশার অনুমতি দিচ্ছে মানেই সাত দিনে সুস্থ হয়ে যাওয়া সম্ভব, তা নয়। রোগ সারতে এক-এক জনের এক-এক রকম সময় লাগে। লাগছেও। কারও পাঁচ দিনে সারছে ঠিকই, কিন্তু অনেকেরই লাগছে এক মাস। এ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে রোগীর উপর চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবেই।
একই মত ফুসফুসের চিকিৎসক প্রার্থপ্রতিম বসুর। তিনি বলেন, ‘‘করোনাভাইরাস অতিরিক্ত ক্ষতিকর নয়। ফলে তার প্রভাব নিয়ে খুব ভয় পাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যে কোনও ভাইরাসের মতো এটিও শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ সৃষ্টি করছে। তা সারার জন্য সময় দিতে হবে। খুব তাড়াহুড়ো করে লাভ হবে না।’’ তাঁর বক্তব্য, ভাইরাস শরীরের ঢুকলে এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক ভাবে প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই হচ্ছে।