সফল বাংলা ছবি তৈরি কী ভাবে সম্ভব? জানালেন টলিপাড়ার পাঁচ নির্মাতা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সময়ের সঙ্গে বাংলা ছবির কাঠামো বদলেছে। বদলেছে গল্প বলার আঙ্গিক। প্রযুক্তির কল্যাণে বদলেছে ছবিমুক্তির কৌশলও। বাংলায় এক দিকে কমছে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা, অন্য দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওটিটির রমরমা। তার উপরে বলিউডের মতো ছবির বক্স অফিসের পরিসংখ্যানও টলিপাড়ায় মেলা ভার। স্বঘোষিত ‘ব্লকবাস্টার’-এর সংখ্যা বেড়েছে। তেমনই, ভাল ছবি ভিড়ের মাঝে হারিয়েও যাচ্ছে। বাংলা ছবির ‘অচ্ছে দিন’-ফিরেছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক অব্যাহত।
বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত অনেকেই মতামত দিয়ে থাকেন, ‘‘আসলে আজকাল তো ছবি হয় না, এক-একটা প্রজেক্ট হয়।’’ কিন্তু এখনও বক্স অফিস-সফল বাংলা ছবি কি হতে পারে না? বক্স অফিসে সফল বাংলা ছবি তৈরির নেপথ্যে কি কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা রয়েছে? সহজ উত্তর হতেই পারে— ছবি তৈরির কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কিন্তু, ‘হিট’ ছবি তৈরির জন্য কাহিনি, চিত্রনাট্য, কাস্টিং ও সঙ্গীতের পাশাপাশি ছবির প্রচার এবং মুক্তির জন্য কী কী কৌশল থাকা আবশ্যিক? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির চার জন পরিচালক ও এক প্রযোজকের কাছে। সাফল্যের চাবিকাঠির সন্ধানে উঠে এল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
শুরু করা যাক সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে। তাঁর ঝুলিতে বক্স অফিসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবি যেমন আছে, তেমনই পরীক্ষামূলক ছবিও রয়েছে। তবে বাংলা ছবির বক্স অফিসের সঠিক পরিসংখ্যান যে পাওয়া যায় না, তা মানতে নারাজ পরিচালক। তাঁর মতে, ‘ফর্মুলা’ বিশ্লেষণের আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন, ‘হিট ছবি’ কাকে বলা যেতে পারে। ইন্ডাস্ট্রিতে পরীক্ষিত পাঁচটি মাপকাঠির উল্লেখ করলেন সৃজিত—
১) প্রতি সপ্তাহে জাতীয় মাল্টিপ্লেক্সের রিপোর্টের সঙ্গে দুই বা তিন গুণ করে নিলে ছবির প্রকৃত ব্যবসা নিয়ে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া সম্ভব বলেই জানালেন সৃজিত। এরই সঙ্গে তিনি জুড়তে চাইলেন স্যাটেলাইট এবং ওটিটি স্বত্বকে। সব মিলিয়ে যদি প্রযোজক টাকা ফেরত পান, তা হলে সেই ছবি সফল।
২) ছবি নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া সৃজিতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই ভাল লাগার প্রতিফলন বক্স অফিসে ঘটতেও পারে, আবার না-ও পারে বলেই মনে করেন সৃজিত।
৩) বক্স অফিসে সফল হয়নি, কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত ছবির সংখ্যাও অগণিত। সৃজিত এই ধরনের ছবিকেও ‘সফল’ বলতে চান।
৪) ছোট হোক বা বড়, পুরস্কার যে কোনও ছবির সাফল্যের মুকুটে অন্যতম পালক হতে পারে বলে মনে করেন সৃজিত।
৫) সব শেষে সৃজিত উল্লেখ করলেন ছবির ওটিটি সাফল্যের কথা। বিষয়টা অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও ছবির সাফল্যের ক্ষেত্রে ইদানীং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মত তাঁর। সৃজিতের মতে, বক্স অফিসে সাড়া ফেলতে পারেনি, অথচ পরে সেই ছবি যদি ওটিটিতে দর্শক দেখেন, তা হলেও ছবিটি সফল হতে পারে।
শুটিং ফ্লোরে ব্যস্ত সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সৃজিতের মতে, উল্লিখিত পাঁচটি মাপকাঠির কোনও একটি বা তার বেশি একটি ছবির ক্ষেত্রে ঘটলে, সেই ছবিকে সফল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। বললেন, ‘‘হয়তো এর মধ্যে আমার কোনও ছবিতে একটি বা দু’টি মাপকাঠি মিলেছে। আবার কখনও হয়তো পাঁচটি মাপকাঠিই মিলে গিয়েছে।’’ ব্যক্তিগত পরিসরে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর ফর্মুলা কী? হেসে বললেন, ‘‘দর্শককে মাথায় রেখে ছবি তৈরিতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি, আমার আনন্দের জায়গা থেকে ছবি তৈরি করি।’’ এ প্রসঙ্গে পাল্টা যুক্তিও দিলেন ‘দশম অবতার’-এর পরিচালক। সৃজিতের ব্যখ্যা, ‘‘আসানসোলের দর্শক যেটা পছন্দ করবেন, সেটা আমেরিকার অস্টিনের দর্শক পছন্দ না-ও করতে পারেন। বেলঘরিয়া এবং বুলগেরিয়ার দর্শকের পছন্দ আলাদা হতেই পারে।’’
ছবি তৈরির ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের বিষয়কেই পর্দায় উদ্যাপন করতে চান সৃজিত। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ছবি তৈরি করি এমন বিষয় নিয়ে, দর্শক হিসেবে যেটা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে আমি দেখতে পছন্দ করব।’’ তাই পাঁচটি মাপকাঠির কোনও একটি যদি তাঁর ছবির সঙ্গে জুড়ে যায়, সেটা তাঁর কথায় ‘উপরি পাওনা’। একই সঙ্গে সৃজিত বললেন, ‘‘আমি তো প্রযোজকের টাকায় ছবি করি। তাই ছবি যদি হিট করে, তা হলে পরবর্তী ছবিটা করতে সুবিধা হয়। সেই জন্যই বক্স অফিস সাফল্যটা জরুরি।’’
বাংলা ছবিকে হিট করাতে হলে ইন্ডাস্ট্রির উদ্দেশে তিনি কী পরামর্শ দিতে চাইবেন? সৃজিত বললেন, ‘‘প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। তারই সঙ্গে আরও নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করা উচিত।’’ কথাপ্রসঙ্গে তাঁর পরিচালিত ‘অতি উত্তম’-এর সঙ্গেই চলতি বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পারিয়া’, ‘বাদামী হায়নার কবলে’, ‘বেলাইন’ এবং ‘ও অভাগী’ ছবিগুলির উদাহরণ দিলেন সৃজিত। বললেন, ‘‘দক্ষিণ ভারতে দেখেছি, মানুষ না জেনেই শুক্রবার বেরিয়ে পড়েন ছবি দেখতে। আমাদের রাজ্যে ছবি দেখার অভ্যাসটা একটু ফিরে এলে ভাল হয়।’’
‘অযোগ্য’ ছবির সেটে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সঙ্গে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বিষয়ভাবনা এবং বক্স অফিসকে বিগত বছরগুলিতে যে সমস্ত পরিচালক একসূত্রে গেঁথেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। কৌশিকের মতে, বক্স অফিসে ছবির ভাগ্য কিছুটা রেসের ঘোড়ার মতো। বললেন, ‘‘কিছু ঘোড়ার নাম আছে। তাদের উপর মানুষ বাজি বেশি ধরেন।’’ ভাল কাহিনি এবং চিত্রনাট্য যে ভাল ছবির চিরকালীন ফর্মুলা, তা বিশ্বাস করেন কৌশিক। তাঁর কথায়, ‘‘ভিত ঠিক না থাকলে কোনও তারকা ছবি হিট করাতে পারবেন না। একটা সময়ে মুম্বইয়ের তারকা এনে বাংলায় ছবি করানো হত। পর পর ফ্লপ ছবি হয়েছে সেই সময়।’’ এই প্রসঙ্গে ‘রাইটার্স বোর্ড’-এর কথা উল্লেখ করলেন তিনি। মুম্বইয়ে একাধিক চিত্রনাট্যকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি চিত্রনাট্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান। কৌশিকের কথায়, ‘‘যে কোনও সন্তান মা-বাবার কাছে আদরের। আমার বহু চিত্রনাট্যের খামতি বন্ধুরা খুঁজে দিয়েছেন। এখানে তো সে রকম কিছু নেই।’’
কৌশিকের মতে ভাল ছবি চলেনি, এ রকম ঘটনা টলিপাড়ায় খুবই কম ঘটেছে। কারণ একটি ছবির জন্ম থেকে মুক্তি পর্যন্ত একাধিক পরিস্থিতি বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে। আবার খারাপ ছবিও অনেক সময় বক্স অফিসে ভাল ফল করে। অনিশ্চয়তা যে সিনেমা শিল্পের অন্যতম অংশ, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন না জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালক। তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘বরং একটা খারাপ ছবি চলেনি বলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি চলছে না— এই অপবাদ নিয়ে আমার আপত্তি রয়েছে।’’
স্যাটেলাইট স্বত্বের কথা ভেবে অনেক তারকাকে ছবিতে নেওয়া হয়। কৌশিক এর মধ্যে কোনও দোষ দেখেন না। তা হলে তাঁর পরামর্শ কী? বললেন, ‘‘এখন মিঠুনদা (মিঠুন চক্রবর্তী), বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) এবং দেবও সময়ের সঙ্গে নিজেদের বদলেছেন। তাই তারকা এবং অভিনেতার মিশ্রণই আদর্শ হওয়া উচিত।’’ তবে ‘কনটেন্ট’ অর্থাৎ বিষয়ভাবনা ভাল না হলে, প্রচার যে ছবিকে এগিয়ে দিতে পারে না, সে কথাও জোর গলায় জানালেন কৌশিক। ছবির প্রচারকে তিনি পোশাকের সঙ্গেই তুলনা করতে ইচ্ছুক। কারণ, মানুষটি ভাল না হলে ভাল পোশাকের আর পৃথক গুরুত্ব থাকে না। কৌশিক হেসে বললেন, ‘‘পচা আলু বা কুমড়ো বিক্রি করা যায় না। দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি হয়, কেটে যাওয়া দুধের ছানা কেউ খায় না।’’
সফল ছবি তৈরি করার আগে পরিচালকের তাঁর ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকা উচিত বলে মনে করেন কৌশিক। বললেন, ‘‘আমি জানি ‘সিনেমাওয়ালা’ বা ‘নগরকীর্তন’-এর দর্শক নিশ্চয়ই ‘দৃষ্টিকোণ’ বা ‘অর্ধাঙ্গিনী’র থেকে আলাদা। সব কবিতা বা গান তো সকলের জন্য নয়।’’ পরিচালক হিসেবে বাংলায় ‘অবলম্বনে’ এবং বায়োপিকের আধিক্য কৌশিককে হতাশ করে। তাঁর প্রশ্ন, “এর ফলে তো সমকালীন গল্প বলা হচ্ছে না! কিন্তু, এতটা ‘নির্ভরশীল’ হয়ে পড়লে এই সময়ের দলিলটা কারা তৈরি করবেন?’’ একই সঙ্গে জানালেন, ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভাল ছবির ধারাবাহিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’ অনেক দেখেছি। যে ব্যাটার শুধুই কভার ড্রাইভ খেলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই বিপক্ষ তাঁর দুর্বলতা ধরে ফেলবে। তাই ক্রমাগত দিক পরিবর্তন করতে হবে।’’
‘আমার বস’ ছবির সেটে রাখি গুলজ়ারের সঙ্গে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি যখন কোণঠাসা, বিগত কয়েক বছরে বাংলা ছবিতে তখন বিষয়বৈচিত্রের নতুন অধ্যায় শুরু করেন পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাংলা ছবির ফর্মুলা বিশ্লেষণে, তাই শিবপ্রসাদ আগাম মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘আমি আর নন্দিতাদি যে হেতু একসঙ্গে ছবি করি, তাই পাঠককে অনুরোধ করব আমার মতামতকে যেন আমাদের দু’জনের মতামত হিসেবেই তাঁরা গ্রহণ করেন।’’ একটি সফল ছবির নেপথ্যে সারা বিশ্বে কাহিনিই প্রাথমিক ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড বলে মনে করেন শিবপ্রসাদ। অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি চরিত্রকে এগিয়ে রাখতে চাইলেন। শিবপ্রসাদের কথায়, ‘‘চরিত্রের থেকে অভিনেতা যেন বড় না হয়ে যায়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।’’ সাফল্যের স্বাদ পাওয়ার পর ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও এক জন তারকাকে কেন্দ্র করে অনেক সময়েই নির্মাতারা পর পর ছবি তৈরি করতে থাকেন। কিন্তু, এই প্রবণতা থেকেও দূরে থাকতে চান শিবপ্রসাদ। নিজের মন্তব্যের পক্ষে উদাহরণও দিলেন পরিচালক। বললেন, ‘‘২০১৬ সালে আমরা ‘প্রাক্তন’ করি। তার পর ৮ বছর কেটেছে, কিন্তু আমরা প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটিকে নিয়ে আর কোনও ছবি করিনি।’’
ছবি হিট করলেই যে সিক্যুয়েল তৈরি করতে হবে, এই নীতিতেও আপত্তি রয়েছে শিবপ্রসাদের। বললেন, ‘‘‘হামি’ সফল হওয়ার পর অনেকেই বলেছিলেন, পরের বছরেই সিক্যুয়েল করতে। কিন্তু আমরা চার বছর সময় নিয়েছিলাম।’’ শিবপ্রসাদ মনে করেন, সফল ছবি তৈরি করতে হলে নির্মাতাদের উচিত নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করা। তা হলে সাফল্য সহজেই ধরা দেবে। প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে ‘উইন্ডোজ়’ (নন্দিতা-শিবপ্রসাদের প্রযোজনা সংস্থা) গল্পকেই সবার আগে প্রাধান্য দেয়। তাঁর কথায়, ‘‘‘কণ্ঠ’ বা ‘গোত্র’ তো সে কথাই বলে। প্রযোজক হিসেবেও আমরা ‘রসগোল্লা’ বা ‘দাবাড়ু’র মতো ছবি করেছি। স্যাটেলাইটের কথা চিন্তা করলে তো আমি ‘দাবাড়ু’তে মুখ্য চরিত্রে ৩০ বছর বয়সি কোনও তারকাকে কাস্ট করতে পারতাম!’’
বাংলা ছবিতে সঙ্গীত এখনও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন শিবপ্রসাদ। তবে তাঁর পরামর্শ, ছবিতে আরও নতুন ধরনের ‘সাউন্ডস্কেপ’ তৈরি করা উচিত। বললেন, ‘‘‘হামি’ এবং ‘হামি ২’ ছবিতে অনিন্দ্যদা (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) বাচ্চাদের দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। আমি আর নন্দিতাদি যখন ছবি করতে আসি, তখন মুম্বইয়ের সঙ্গীত পরিচালকেরা বাংলায় কাজ করতেন। এমনকি, ছবি হিসেবে ‘রিমেক’ ছিল প্রধান। আমাদের কিন্তু এখনও পর্যন্ত ডাবিংয়ের সাহায্য নিতে হয়নি।’’ পরিচালকের মতে, মৌলিক চিত্রনাট্য বা সঙ্গীতের সাফল্যের স্বাদ শিল্পীকে পরবর্তী কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করে।
বাংলা ছবির প্রচারের ধরনও একই রকমের বলে উল্লেখ করলেন শিবপ্রসাদ। সেখানে নেই কোনও নতুনত্ব। তাঁর কথায়, ‘‘‘ইন ফিল্ম’ প্রচারও একই রকম। কেউ ১০টা ব্র্যান্ড আনলে, অন্য জন ২০টা আনছেন। এতে কোনও লাভ নেই।’’ পরিচালকের মতে, ডিজিটাল যুগে দর্শক যথেষ্ট সচেতন। তাই শুক্রবারে নতুন কনটেন্টের ভিড়েও তিনি তাঁর পছন্দ অনুযায়ী ছবি বেছে নেন। শিবপ্রসাদের কথায়, ‘‘‘লাপতা লেডিজ়’ হলের পাশাপাশি ওটিটিতেও চলে এল। ছবিটার জন্য নির্মাতারা কি খুব বেশি প্রচার করেছেন? তার পরেও তো পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ ছবিটা দেখেছেন!’’
বাংলার বক্স অফিস নিয়ে আলাদা করে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ শিবপ্রসাদ। তবে বাংলার বক্স অফিস প্রসঙ্গে তাঁর সরস মন্তব্য, ‘‘কেউ যদি বলেন যে, তাঁর ছবি দারুণ ভাল ব্যবসা করছে, তা হলে তো ভূষণ কুমার (প্রযোজনা সংস্থা টি সিরিজ়ের কর্ণধার) বা বনি কপূর (‘ময়দান’ ছবির অন্যতম প্রযোজক) তাঁর কাছে ছুটে চলে আসবেন! কারণ প্রকৃত সত্য আজকের দিনে চাপা রাখা কঠিন।’’ কথাপ্রসঙ্গেই আঞ্চলিক ভাষায় ‘বেলাশুরু’ ও ‘হামি’র স্বত্ব বিক্রির কথা জানালেন শিবপ্রসাদ। বললেন, ‘‘‘পোস্ত’ ও ‘প্রাক্তন’ হিন্দিতেও তৈরি হয়েছে। মালয়লামে ‘কণ্ঠ’ তৈরি হয়েছে। এটাই বলতে চাইছি, ছবি ভাল হলে তাকে আটকে রাখা যায় না।’’
‘আবার প্রলয়’ ওয়েব সিরিজ়ের শুটিং ফ্লোরে রাজ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
সুপারহিট বাণিজ্যিক ছবির হাত ধরেই এক সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের নীচে জমি শক্ত করেছিলেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। এখন মূল ধারার ছবির পাশাপাশি অন্য ধারার ছবিতেও তিনি মনোনিবেশ করেছেন। ছবি হিট করানোর জন্য তাঁর গুপ্তমন্ত্র কী? রাজ হেসে বললেন, ‘‘কাহিনির মধ্যে সুন্দর সুন্দর ‘প্লট পয়েন্ট’ থাকতে হবে। মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবি হলে, সেখানে প্রেম, কমেডি, সব কিছুর সঙ্গেই সামাজিক কোনও সমস্যাকে তুলে ধরতে পারলে খুব ভাল।’’ রাজ বিশ্বাস করেন, সিনেমার কাজ বিনোদনের পাশাপাশি মানুষের মন জয় করে নেওয়া। তাঁর মতে, গল্প যদি দর্শকের একঘেয়ে মনে হয়, তা হলে কোনও লাভ নেই। বললেন, ‘‘অনেক সময় দেখেছি, ভাল ছবি, কিন্তু উপস্থাপনের কায়দাটা ঠিক নয়। তাই ছবির মধ্যে যেন একটা ম্যাজিক বা নতুনত্ব থাকে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’’
পরিচালক হিসেবে রাজ এটা বোঝেন যে, দর্শক আগের থেকে আজ অনেক বেশি পরিণত। ফলত, তাঁদের বোকা বানানোর চেষ্টা করা বৃথা। তাঁর কথায়, ‘‘২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে যুক্তি দিয়ে ছবি তৈরি করতে হবে। কারণ, প্রথম ছবিতে বিশ্বাস তৈরি হলে, তবেই দর্শক একজন পরিচালকের পরের ছবিটি দেখতে যাবেন।’’ একই সঙ্গে নির্মাতারা যেন পুনরাবৃত্তি না করেন, সে দিকেও জোর দিলেন রাজ।
ছবিতে তারকা বনাম অভিনেতা নির্বাচন বিতর্কে না প্রবেশ করতে চেয়ে রাজের সহজ উত্তর, ‘‘আমি এমন অনেককে নিয়েই ছবি করেছি, যাঁরা পরবর্তী সময়ে ‘সুপারস্টার’ হয়েছেন।’’ তবে অভিনেতাকে কেমন দেখতে, তার উপরেও অনেক সময় দর্শকের বিভাজন নির্ভর করে বলে জানালেন রাজ। গল্প অনুযায়ী ছবির বাজেটও নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ বললেন, ‘‘আমি এখন সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে কোনও ছবি তৈরি করলে তার বাজেট নিশ্চয়ই ‘প্রলয়’ বা ‘বরবাদ’-এর তুলনায় বেশি হবে।’’ সিনেমার ভবিষ্যৎ যে হেতু দর্শকের হাতে, তাই রাজ মনে করেন, শুরুতেই ধরে নেওয়া উচিত ছবি হিট করার চান্স ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ অনিশ্চিত।
ভারতের মতো দেশে সফল ছবির নেপথ্যে থাকে ভাল গানের ব্যবহার। রাজ বিশ্বাস করেন, গান এমন হতে হবে, সেটা যেন যে কোনও অনুষ্ঠানে বাজে বা ছোট-বড় প্রত্যেকে শোনেন। গানের দৌলতে আপাতদৃষ্টিতে খারাপ ছবিও যে বক্স অফিসে এক সময় রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে, সে কথা মনে করিয়ে দিতে চাইছেন পরিচালক। বলছিলেন, ‘‘অনেক ছবি শুধু গানের জন্য দর্শক দেখেন বা মনে রাখেন। আমার একাধিক ছবির গান এখনও দর্শক শোনেন।’’ ‘রিল’-এর জগতে পরিচালককে সব দিক চিন্তা করেই ছবির পরিকল্পনা করতে হবে বলে জানালেন রাজ। তাঁকে ভাবতে হবে, যেন তাঁর ছবির আবহসঙ্গীতকে নেটাগরিকরা রিলে ব্যবহার করেন, পরামর্শ রাজের।
ছবি হিট করানোর জন্য প্রচারের উপর আলাদা গুরুত্ব দিতে চাইলেন রাজ। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ তাঁর ছবিকে কী ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, তার উপরেও ছবির ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভর করে। কী আসছে? এই প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’ এরই সঙ্গে বক্স অফিস প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জানালেন রাজ। তাঁর মতে, মানুষকে ভুল না বুঝিয়ে মাটিতে পা রেখে অগ্রসর হলে সাফল্য ঠিকই আসে। ছবির প্রচারে যা ইচ্ছে করা যায়, কিন্তু সেখানেও সীমারেখা মেনে চলা উচিত। বললেন, ‘‘আমার ছবি ১ কোটির ব্যবসা করেছে। এ দিকে আমি বলছি ১০ কোটি! দর্শক হলে ঢুকে দেখছেন, সিংহভাগ আসন খালি। এই ভুল বার্তা দেওয়া ঠিক নয়।’’ পরিচালকের মতে, ছবি হিট করেছে কি না, সেটা দর্শক নিজের মুখে বলাটাই শ্রেয়।
এরই সঙ্গে রাজ যোগ করতে চাইলেন বাংলা ছবির প্রতি বঞ্চনার প্রসঙ্গ। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘হিন্দি ছবির সঙ্গে লড়াই করে বাংলা ছবি জায়গা পাচ্ছে। ছবি হিট করবে কী করে! ‘পুষ্পা ২’ আসছে বলে আমাকে বুঝে ‘বাবলি’ রিলিজ় করতে হবে।’’ তবে তার জন্য হলমালিকদের দোষারোপ করতে চাইলেন না রাজ। তাঁর কথায়, ‘‘দক্ষিণী ছবি যে ব্যবসা দিচ্ছে, তা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা ‘পুষ্পা ২’ দেখাতে চাইবেন। আমি স্বীকার করছি, আমরা সেই জায়গায় বাংলা ছবিকে উন্নীত করতে পারিনি, যাতে প্রদর্শকেরা আমাদের অগ্রাধিকার দেন।’’
‘প্রধান’ ছবির সেটে শুটিংয়ের ফাঁকে দেবের সঙ্গে অতনু রায়চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রযোজক হিসেবে অতনু রায়চৌধুরীর কেরিয়ারে ‘ফ্লপ’ ছবি আছে কি? আতশকাচ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। সফল ছবির ফর্মুলাগুলি তাঁর নজরে কী রকম? অতনু বললেন, ‘‘যাঁর ছবির বিষয়ভাবনা যত ভাল, তাঁর ছবি তত বড় হিট হতে পারে।’’ কাহিনির পাশাপাশি চিত্রনাট্যের উপরেও সমান গুরুত্ব দিতে চাইলেন অতনু। কারণ, তাঁর মতে, ভাল গল্প বলাটা নির্ভর করে চিত্রনাট্য এবং সংলাপের উপর। বললেন, ‘‘আমার সাম্প্রতিক ছবির ক্ষেত্রে বলতে পারি, অভিজিৎ (পরিচালক অভিজিৎ সেন) এবং শুভদীপের সঙ্গে দেবও চিত্রনাট্যে মতামত দেয়। এটা একটা দলগত প্রয়াস।’’
‘টনিক’ ও ‘প্রজাপতি’র পর ‘প্রধান’— অভিজিতের সঙ্গে পর পর তিনটি ‘ব্লকবাস্টার’ ছবি উপহার দিয়েছেন অতনু। ছবি সফল হয়েছে বলেই কি একই পরিচালকের সঙ্গে পর পর ছবি করছেন? অতনুর যুক্তি, ‘‘আমার মতে, দর্শকের কাছে একটা ভাল গল্প তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অভিজিতের থেকে আর ভাল কেউ নেই বলেই, ওর সঙ্গে কাজ করেছি। ফলাফল সকলেরই জানা।’’ তারকা এবং অভিনেতা— উভয়কে নিয়েই কাজ করেছেন। তবে তাঁর কথায়, ‘‘এক জন ভাল অভিনেতা যদি তারকা হন, সেটাও ছবির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেয়।’’ দেবের মতো তারকা যেমন তাঁর ছবিতে রয়েছেন, তেমনই ছোট পর্দার জনপ্রিয় মুখ সৌমীতৃষা কুন্ডু বা শ্বেতা ভট্টাচার্যদেরও তিনি সুযোগ দিয়েছেন। অতনু বললেন, ‘‘ওঁরা ভাল অভিনেতা বলেই তো ছোট পর্দায় জনপ্রিয়। সেটাকে বড় পর্দায় কাজে লাগানো যেতেই পারে। আবার বড় পর্দায় যে ছোট পর্দার সকলেই সমান জনপ্রিয়তা পাবেন, সেটা ঠিক না-ও হতে পারে।’’ ছবি হিট করার নেপথ্যে ভাল গান এবং আবহসঙ্গীতের অবদানও উল্লেখ করতে চাইলেন অতনু।
বর্তমানে অনেকেই মনে করেন, প্রেক্ষাগৃহ থেকে বাংলা ছবির টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। কিন্তু অতনু জানালেন, লাভের মুখ দেখতে তিনি প্রেক্ষাগৃহের উপরেই ভরসা করেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি হলের জন্য ছবি তৈরি করি। স্যাটেলাইট বা ওটিটি থেকে যা আসে, সেটা উপরি পাওনা।’’ এই প্রসঙ্গেই তাঁর পরামর্শ, ছবির বাজেট কী হবে, তা শুরু থেকেই ভেবে নিতে হবে। না হলে বিপদ! অতনুর প্রশ্ন, ‘‘প্রযোজক সর্বস্ব বিনিয়োগ করলেন, এ দিকে ছবি চলল না। তা হলে তিনি পরের ছবিটা তৈরি করবেন কী ভাবে?’’
সব শেষে বলা যেতে পারে, সফল ছবি তৈরির যে কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই, তা এত ক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বরং বলা যেতে পারে, নির্মাতার গবেষণাগারে একাধিক বিজ্ঞানীর একাধিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতেই একটি ছবি হিট থেকে সুপারহিটের দিকে এগোতে থাকে। সেখানে সাফল্যের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বিষয়ভাবনা বা কাহিনিকে এগিয়ে রাখতে চেয়েছেন। পাশাপাশি বোঝা গেল, ছবি সফল হওয়ার ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও মুক্তি পর্যন্ত ছোট ছোট একাধিক শর্ত পূরণ হওয়াটা আবশ্যিক। আসলে উপযুক্ত উপকরণ এবং সময়ের সঠিক ব্যবহারেই একটি রান্না করা পদ সুস্বাদু হয়ে ওঠে। কখনও কখনও সেখানে নুনের তারতম্য ঘটতেই পারে। ভাল রাঁধুনি যেমন ভাল রান্না করেও নতুন কিছু তৈরির প্রচেষ্টায় ব্রতী হন, তেমনই ভাল ছবি তৈরির প্রচেষ্টায় ছেদ পড়লেও চলবে না।