অভিনেতা রবি ঘোষ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
রবিদার জন্মদিন। রবি ঘোষ মানেই আমার কাছে অজস্র স্মৃতি। তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে আমি তাঁকে আমার ছবিতে পেয়েছিলাম। পর পর তিনটি ছবি—‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পতঙ্গ’। আমার কেরিয়ারে বাংলার পাশাপাশি মুম্বই এবং দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির বহু অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু বলতে পারি, রবিদা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নট।
রবিদার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের আলাপ। তিনি কমল মজুমদারের অনুরাগী ছিলেন। কারণ, কমলদা এক সময় রবিদা, বসন্ত চৌধুরীদের নিয়ে নাটকও করেছিলেন। তাই ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় জ্যোতিষী অনন্তহরির চরিত্রে রবিদাকে ভাবলাম। শুনে বললেন, ‘‘কমলবাবুর বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে কী ভাবে তুমি ছবি করবে, আমি জানি না।’’ কিন্তু, শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। সুনীলদার (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) বাড়িতে চিত্রনাট্য পড়া হল। সুনীলদা আমাকে সংলাপ পরিমার্জনায় অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন। ছবির প্রেক্ষাপট উনবিংশ শতক। একটাই লোকেশনে শুটিং হবে। তাই এমন জায়গায় শুটিং করতে হবে, যেখানে কোনও বিদ্যুতের খুঁটি থাকবে না। সেই মতো ইউনিট নিয়ে সাগর দ্বীপে শুটিং করা হল। কুটিল চরিত্র, অথচ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন রবিদা। দেখতাম, তাঁর শট না থাকলেও ফ্লোরে বসে শুটিং দেখতেন রবিদা। বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলতেই বললেন, ‘‘বলছ কী গৌতম! আমরা এখন উনবিংশ শতকে পৌঁছে গিয়েছি। আমি এখান থেকে কোথাও যেতে রাজি নই।’’ রবিদার রসবোধ আজও মিস করি।
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিকে) রবি ঘোষ এবং বসন্ত চৌধুরী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
প্রথম ছবিতেই রবিদার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। ভবানীপুরে তাঁর পুরনো বাড়িতে বহু দিন আড্ডা দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে রবিদা যখন গল্ফ গ্রিনে চলে আসেন, সেই বাড়িতেও গিয়েছি। রবিদা, সৌমিত্রদা (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) আমরা একসঙ্গে বহু আড্ডা দিয়েছি। রবিদা ছিলেন মজার মানুষ। মানুষকে সাহায্য করতেও পছন্দ করতেন। একটা ঘটনা জানাই। আমি তখন সবে গোলপার্কে সরকারি আবাসনের বাড়িতে এসেছি। ঘরের ফ্যানগুলো খুব ছোট ছিল। তখনও বদলানো হয়নি। প্রচণ্ড গরম। সৌমিত্রদা, রবিদা এসেছেন। ডিনার করে সবাই বাড়ি ফিরে গেলেন। পরের দিন সকালে দেখি রবিদার ড্রাইভার একটা পেল্লায় স্ট্যান্ড ফ্যান নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির। সঙ্গে একটা চিঠি। সেই চিঠিতে রবিদা লিখেছেন, ‘‘গৌতম, এই ফ্যানটা আমার বাড়িতে কোনও কাজে লাগে না। তুমি ফ্যানটাকে তোমার স্টাডিতে রেখো। সারা দিন পর বাড়ি ফিরে স্নান করে একটা লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে চেয়ারে বসে ফ্যানের হাওয়া খাবে। ফুরফুরে মেজাজে রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ো।’’ সে সব দিনগুলো এখনও আমার স্মৃতিতে টাটকা।
নাটক রবিদার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ি ছিল। উৎপলদার উপরে তথ্যচিত্র তৈরি করছি (‘ইন সার্চ অফ থিয়েটার: উৎপল দত্ত’)। তার জন্য বেশ কিছু নাটক আমি পুনর্নির্মাণ করেছিলাম। মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহ তখন বন্ধ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের থেকে অনুমতি নিলাম। মিনার্ভার দরজা খোলা হল। সেখানে পৌঁছে উৎপলদা, রবিদা সকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। ‘অঙ্গার’ নাটকের শুটিং করা হবে। রবিদার লম্বা সংলাপ। রবিদাকে বইটা দিতে বললেন, প্রয়োজন নেই। অত বছর পরেও দীর্ঘ সংলাপ নির্ভুল বলে গেলেন। উৎপলদাও দেখে অবাক। তিনি রবিদাকে জিজ্ঞাসা করতেই রবিদা বলেছিলেন, ‘‘আরে, মনে থাকবে না উৎপলদা! কত রজনী ‘অঙ্গার’ করে কটেছে। ও তো ভেতরে ঢুকে রয়েছে।’’
রবিদা ছিলেন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দর্শকের একটা বড় অংশ রবিদাকে কমেডিয়ান হিসেবেই মনে রাখলেন। উৎপলদার বাড়িতে ‘পদ্মানদীর মাঝি’র চিত্রনাট্য পড়া হচ্ছে। রবিদাকে আমিনুদ্দিনের চরিত্র দিলাম। প্রথমে রাজি হলেন না। কারণ, দর্শক নাকি তাঁকে দেখে হাসবেন। আমি বলেছিলাম, প্রথমে হাসবেন, কিন্তু তার পর ছবি দেখে আর হাসবেন না। আমার উপর ভরসা করে রাজি হলেন রবিদা। ছবির প্রিমিয়ারে সকলেই রয়েছি। আমার কথা মিলে গেলে। প্রথম দৃশ্যে রবিদাকে দেখে প্রেক্ষাগৃহে হাসি। কিন্তু, তার পর দর্শক আর হাসলেন না। ছবি শেষ হল। রবিদা বললেন, ‘‘গৌতম তুমি কী ভাবে বুঝলে! তোমার ভবিষ্যদ্বাণী তো মিলে গেল!’’
উৎপল দত্তের স্মরণসভায় (বাঁ দিক থেকে) রবি ঘোষ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং গৌতম ঘোষ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
রবিদার ক্ষমতা ছিল, চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারতেন। সংযত অভিনয়। থিয়েটার এবং সিনেমার মধ্যে অভিনয়ের পার্থক্যটা বুঝতেন। কখনও ফ্লোরে নিজেই বলতেন, ‘‘ইস, একটু থিয়েটারের মতো করে ফেললাম! আরও এক বার শট দেব।’’ সত্যজিৎ রায় এবং তপন সিংহের সঙ্গে বহু কাজ করার ফলে, ছবিতে অভিনয়ের খুঁটিনাটি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে দর্শক তাঁকে পছন্দ করেছিলেন। তার পর ‘পতঙ্গ’ হিন্দি ছবি। কিন্তু গয়ার স্থানীয় সংলাপের ধরন একদম রপ্ত করে ফেলেছিলেন রবিদা। দুষ্টু পুলিশের চরিত্রে ছিলেন রবিদা। সম্প্রতি ছবিটা রেস্টোর করা হয়েছে। ওটিটিতে এলে, আমার বিশ্বাস, দর্শক আবার ছবিটা দেখবেন।
এর পর তো রবিদা চলেই গেলেন। তাঁর স্মৃতি রয়ে গেল আমার ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে। কী অদ্ভুত, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র সব চরিত্রই উপস্থিত রয়েছেন। এ দিকে রবিদা নেই। শুটিংয়ের সময় সৌমিত্রদা, শর্মিলা (শর্মিলা ঠাকুর), শুভেন্দুদা (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়), শমিত ভঞ্জ— প্রত্যেকের মুখে রবিদার গল্প ফিরে ফিরে আসত। ছবিটার শুটিং তো বটেই, চিত্রনাট্য লেখার সময়েও রবিদাকে খুব মিস করতাম। কারণ, তাঁর কথা ভেবে সেই ভাবে অন্য চরিত্রদের মুখে সংলাপ বসিয়েছিলাম।
আগাধ পাণ্ডিত্য, রসবোধ, মাটিতে পা রেখে চলা— রবিদাকে ভোলা মুশকিল। রবিদার স্ত্রীও তো সে দিন চলে গেলেন। মনে পড়ছে, রবিদার স্মরণসভাতেও আমার দারুণ একটা উত্তরণ হল। আমি আর সৌমিত্রদা বেরিয়ে এলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। দাদা বললেন, ‘‘গৌতম, রবি তো চলে গেল। চলো না, এ বার আমি আর তুমি একটা কাজ করি। এত দিন ধরে পরিকল্পনা হচ্ছে। এ বার তো শুরু করা যাক।’’ সেই ভাবেই ‘দেখা’ ছবিটা তৈরি হল। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৯৩তম জন্মদিন হত। রবিদা, আপনি যেখানেই রয়েছেন, আশা করি ভাল আছেন। চারপাশটাকে আপনার মতো করেই আলোয় ভরিয়ে রেখেছেন। জন্মদিনে আমার প্রণাম নেবেন।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)