(বাঁ দিকে) সলিল চৌধুরী। দেবজ্যোতি মিশ্র (ডান দিকে)। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
‘সলিল চৌধুরী’ নামটা উচ্চারিত হলেই শরীরময় যেন আলোকশিখা জ্বলে ওঠে। তিনি আমার গুরু। আমার সৌভাগ্য, তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছি। আনন্দবাজার অনলাইনের অনুরোধে আজ তাঁর প্রাক্-জন্মশতবার্ষিকীতে ভাবতে বসে আমি শুরুর দিনগুলোকে একটু ফিরে দেখতে চাই।
খুবই অল্প বয়সে আমার পেশাগত জীবন শুরু হয়। আশির দশকের শুরুর দিকে ভায়োলিনিস্ট হিসেবে তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাচ্ছি। আমার বাবা জাহ্নবীরঞ্জন মিশ্র ছিলেন আমার ভায়োলিনের ভগীরথ। ছোট থেকেই দেখতাম, বাড়িতে সলিল চৌধুরীর গান হয়ে আসছে। ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ গানটা ছিল আমার পরিবারের অ্যান্থেমের মতো। আমার বাবা, ঠাকুমা, বাবুকাকা গানটা গাইতেন। মজার বিষয়, আমি নিজেও বেহালায় প্রথম এই গানটাই তুলেছিলাম।
তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। ‘প্রতিধ্বনি’ নামে একটা দলের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সেখানে মূলত সলিল চৌধুরীর কয়্যারের গান গাওয়া হত। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কল্যাণ সেনগুপ্ত, অশোক দাশগুপ্ত, লাল্টু দাশগুপ্ত, পার্থ সেনগুপ্ত এবং চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ। শহরে আমাদের একটি অনুষ্ঠানে আমার বন্ধু ও পারকাশনিস্ট সুব্রত ভট্টাচার্য সলিল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ করেন।
অনুষ্ঠানের দিন সলিলদা যে সত্যিই দর্শকাসনে বসে রয়েছেন, আমি জানতাম না। অনুষ্ঠান শেষে তিনি মঞ্চে এলেন। এখনও মনে আছে, আমার গায়ে শিহরণ খেলে গেল। এক কোণ থেকে সকলকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আমার সামনে এসে বললেন, ‘‘তোমার বাজনা শুনলাম। তোমার ভায়োলিন খুব ভাল লেগেছে।’’ এখনও মনে আছে, ঘটনার আকস্মিকতায় সলিলদাকে আর প্রণাম করতে পারলাম না। আমি কেমন যেন পাথর হয়ে গেলাম। এগোতে পারলাম না। চোখের সামনে সলিল চৌধুরী দাঁড়িয়ে এবং তিনি আমার বাজনার প্রশংসা করছেন! আজও দিনটা ভুলতে পারিনি।
স্বরলিপি কী ভাবে দ্রুত লিখতে হয়, সেটা বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। সলিল চৌধুরী সেটা নিজের চোখে দেখলেন। সেই আমাদের যোগসূত্র তৈরি হল। টালিগঞ্জের চণ্ডীতলা থেকে আমি যে বেরোলাম, তার পর সলিল চৌধুরীর হাতে গিয়ে পড়লাম। বাবা যদি আমার জীবনে সঙ্গীতের ব্যাকরণ হন, তা হলে সলিল চৌধুরী ছিলেন আমার মুক্তধারা। তিনি মধ্যরাতে আমাকে একের পর এক সিম্ফনি শুনিয়েছেন। রেকর্ড প্লেয়ারে এক দিকে বেঠোভেন শোনাচ্ছেন, তেমনই আবার আমির খাঁর ললিত এবং মাড়োয়া রাগও শোনাচ্ছেন। সলিলদা নিজে দ্রুত গতিতে রেকর্ড চালাতে পারতেন। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রথম মুভমেন্ট থেকে সেকেন্ড মুভমেন্টে রেকর্ডের পিনটা চট করে সরিয়ে দিতেন। কত দিন এমন হয়েছে, লোয়ার রওডন স্ট্রিটে ‘আকাশদীপ’-এ তাঁর ফ্ল্যাটে আমি থেকে গিয়েছি। সবিতা চৌধুরী আমার জীবনে ছিলেন মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। আমার মা-ই ছিলেন তিনি। আমার বাবার শারীরিক অসুস্থতার সময়েও সলিলদা সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এইচএমভি, দক্ষিণ ভারতের প্রসাদ ডিলাক্স-সহ একাধিক রেকর্ডিং স্টুডিয়োর ফ্লোরে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। ফার্ন রোডে তাঁর অফিস ছিল। সেখানে অজস্র তারকার সঙ্গে সলিলদার কথোপকথনের সামনে অবাক শ্রোতা হয়ে বসে থেকেছি।
সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেবজ্যোতি মিশ্র। ছবি সৌজন্যে: সুব্রত ভট্টাচার্য।
এখন প্রশ্ন হল, ভারতের সমকালীন সঙ্গীত জগতে দাঁড়িয়ে আমরা সলিল চৌধুরীকে কী ভাবে দেখব। সেটা হয়তো বোঝা যাবে তাঁর প্রতিভা, মানুষের প্রতি ব্যবহার এবং সৃষ্টিভাবনার অভিনবত্বের নিরিখে। ‘ঘুম ভাঙার গান’ অ্যালবামে প্রতিটি গানের আগে বলার জন্য ভাষ্য তৈরি করছেন সলিলদা। লেখার পর সেগুলো আমাকে এবং রেকর্ডিস্ট সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় তিনি শোনাতেন। সেখানে চল্লিশের দশকে সলিলদার স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ— সব কিছুই ধরা পড়েছে। শুনতে শুনতে বুঝতে পারতাম, মানুষটা খুব বড় কবিও।
সলিলদা গান তৈরি করেছেন ফর দ্য পিপল্, বাই দ্য পিপল্ এবং অফ দ্য পিপল্। তিনি কখনও একা খেতেন না। সকলকে নিয়ে একসঙ্গে খাবার খেতেন। সহকারী থেকে শুরু করে ফ্লোরের ক্ষুদ্রতম কর্মীদের প্রতিও তাঁর মমত্ব মনে রাখার মতো। জীবনে একাধিক ধাক্কা এলেও মানুষের প্রতি তাঁর ভরসা, বিশ্বাস এবং ভালবাসা কোনও দিন হারিয়ে যায়নি। মানুষের সঙ্গে এই সম্পর্কটা, শিল্পী এবং মানুষ হিসেবে তাঁকে আরও বড় সিংহাসনে বসিয়ে দেয়। মনে আছে, সলিলদা যে দিন চলে গেলেন, সে দিন তাঁর গাড়ির চালক বলেছিলেন যে, তিনি আর কখনও গাড়ি চালাবেন না। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি সলিল চৌধুরীর থেকে কী নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, তা হলে বলব, মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এবং ভালবাসা। আর অবশ্যই তাঁর মিউজ়িক্যালিটি।
একটা ঘটনা বলি, তা হলে সেই সময়টা সম্পর্কে পাঠকের একটা ধারণা তৈরি হবে। সলিলদার সঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যাব। যাওয়ার আগে সুচিত্রা মিত্রকে তাঁর বাড়ি থেকে গাড়িতে তুলে নিলেন সলিলদা। একসঙ্গে তাঁরা গান তৈরি করছেন। এক সময় সুচিত্রাদিকে নিয়ে সলিলদা একটা কাজে বেরোলেন। আবার ফিরে আসবেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে বললেন, ‘‘সলিল আমাদের মধ্যে এমন কবিতা লিখে ফেলেছিল, যা প্রশংসনীয়।’’ তার পর সলিলদার লেখা ‘শপথ’ কবিতাটির সঙ্গে মায়াকভস্কির (রাশিয়ান কবি ভ্লাদিমির মায়াকভক্সি) ‘ক্লাউড ইন ট্রাউজ়ার’ কবিতাটির তুলনা করলেন তিনি।
একটা অনুষ্ঠানে বাংলা গান কেন সেই ভাবে আর হচ্ছে না— এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলছেন। সলিলদাও দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। মঞ্চে উঠে তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, ‘‘সলিলদা আর গান তৈরি করছে না। তাই আর গান হচ্ছে না। আমার আর কিছু বলার নেই।’’ মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন তিনি। আজও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ‘মোকাম্বো’ রেস্তরাঁ থেকে সলিল চৌধুরী এবং সুধীন দাশগুপ্ত বেরিয়ে একই ট্যাক্সিতে উঠলেন। সঙ্গে আমি। সুধীনবাবু গান ধরলেন ‘পথ হারাব বলেই এ বার পথে নেমেছি’। সলিলদা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। এখনও ভুলতে পারি না মুহূর্তগুলো।
সলিলদার থেকেই তাঁর আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি। তৎকালীন বম্বেতে সুরকার মদনমোহনের সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যেতেন সলিলদা। দু’জনে একসঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতেন। ভাবাই যায় না! সুরকার রোশন প্রয়াত হওয়ার পর সলিলদা বলেছিলেন, ‘‘আমার গান আর কে শুনবে!’’ শচীন দেব বর্মণ গান তৈরি করছেন। আবহসঙ্গীতের জন্য আসতেন সলিল চৌধুরীর কাছে। পঞ্চমদার (রাহুল দেব বর্মণ) কাছে শুনেছি, সলিলদাকে শচীন দেব বর্মণ নাকি বলতেন, ‘‘অগো আমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িক পছন্দ হচ্ছে না! তুমি কইরা দাও সলিল।’’
আগামী বছর পরিচালক ঋত্বিক ঘটকেরও জন্মশতবর্ষ। ঋত্বিকের জীবনেও সলিলদার অনেক অবদান রয়েছে। সলিলদা ঋত্বিককে বম্বেতে ডেকে পাঠালেন। গল্প লিখতে বললেন। ঋত্বিক লিখলেন। তা থেকে তৈরি হল ‘মধুমতী’ ছবিটি। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির আবহসঙ্গীত শুনলে উপলব্ধি করা যায় দুই বন্ধুর নিবিড় সখ্যকে। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ গানটা তো সলিলদা প্রথমে ঋত্বিকের ‘কোমলগান্ধার’ ছবিটির জন্য লেখেন। কিন্তু কোনও কারণে গানটা ছবিতে গেল না। ঋত্বিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সলিলদাকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখেছি। সলিলদা ঋত্বিকের ক্যামেরা সেন্সের প্রশংসা করতেন। বলতেন, ‘‘ও যেখানেই ক্যামেরা বসাতে বলত, সেটাই ছিল আদর্শ ক্যামেরা অ্যাঙ্গল।’’
দক্ষিণ ভারতের একটি স্টুডিয়োয় সলিল চৌধুরী কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই প্রবেশ করেছেন। সামনে প্রায় ৭০-৮০ জন শিল্পী। মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম, কী ভাবে যেন অর্কেস্ট্রেশন করে ফেললেন। আজও ভাবলে আমি বিস্মিত হই। কোনও বাংলা গান থেকে হয়তো মালয়ালম গান তৈরি করছেন। একদম অন্য ধরনের সঙ্গীতায়োজন। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ১৯৬৫ সালে ‘চেম্মিন’ ছবিতে তাঁর সুর কেরলের সঙ্গীতকেই বদলে দিয়েছিল। বলতে বাধা নেই, মালয়ালম দুনিয়ায় বাংলার তুলনায় সলিল চৌধুরীকে আরও বেশি করে উদ্যাপন করা হয়। কেরলে সঙ্গীত রিয়্যালিটি শোয়ে ‘সলিল চৌধুরী রাউন্ড’ হয়। সেটা আমাদের এখানে সম্ভব নয় কেন? আমাদের তো তাঁকে আরও বেশি উদ্যাপন করা উচিত। এই প্রজন্মের তরুণেরা কী ভাবে সলিল চৌধুরীর কাছে পৌঁছবে, সেটা দেখা প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় তাঁকে আমরা শুধুই প্যান ইন্ডিয়া স্তরে আটকে রাখলাম।
পরিচিতি, খ্যাতি, পুরস্কার— এ সব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না সলিলদার। খাজুরাহোর শিল্পকলা দেখে মানুষ যেমন স্রষ্টার সন্ধান করেন, বিস্মিত হন, তেমনই সলিল চৌধুরীর কোনও গান শুনলেও অপিরিচিতের মনে একই উপলব্ধি হয়। সঙ্গীতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। তিনি জানতেন, কত ধানে কত চাল। তাই তো তিনি দিয়ে যেতে পারেন ‘হেই সামালো ধান হো’। ‘আনন্দ’ ছবিতে তিনি সুপারস্টার রাজেশ খন্নাকে ‘জ়িন্দগি’র মতো গান উপহার দিয়ে যান। ‘মধুমতী’তে তৈরি করেন ‘আজা রে পরদেশি’র মতো অসামান্য একটি গান কিংবা ‘পরখ’ ছবিতে ‘ও সজনা’র মতো গান। যিনি লিখতে পারেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’, তিনি তো বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি-গীতিকার।
(বাঁ দিক থেকে) মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী এবং বাসু চট্টোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫! পিতৃহারা হলাম। দুর্বিষহ একটা দিন। সলিলদা চলে গেলেন। মনে আছে, শেষযাত্রায় অনেকের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার, ‘প্রতিধ্বনি’ দলের সব সদস্য এবং কে নয়! মনে আছে, নন্দনে আমি প্রচুর পোস্টার লিখেছিলাম। তার পর তাঁর গান গাইতে গাইতে শেষযাত্রায় যোগ দেন অগণিত অনুরাগী। সকলের মুখে ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানটি। তবে আমি বিশ্বাস করি, সলিল চৌধুরীর মতো মানুষের জন্ম হয় না, তাঁদের আবির্ভাব হয়। তাঁদের মৃত্যু হয় না, মহাপ্রস্থান হয়। সলিলদাকে প্রণাম করতে গেলেই বলতেন, ‘‘আমার হাঁটুর তলায় কিছু নেই। একদম প্রণাম করবি না।’’ কিন্তু একমাত্র সে দিনই তাঁকে আমি প্রণাম করেছিলাম। কিন্তু তত ক্ষণে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছেন।
সময় যত এগিয়েছে, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়েছে। আজ সেটা বেশি করে বুঝতে পারি। কারণ এভারেস্টের থেকে দূরে না দাঁড়ালে, তার শিখর দেখা যায় না। তাই আমি দূর থেকেই সেই শৃঙ্গকে দেখি। ব্যক্তি, সঙ্গীতশিল্পী, কবি, একজন পরিব্রাজক, জীবন নির্দেশক সলিল চৌধুরী— একটা বড় বিস্ময়। তাঁকে অনুভব করা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। স্পর্শ করা যায় না। শতবর্ষের প্রাক্-মুহূর্তে আমার তো মনে হয়, ভারতবাসী আরও বহু বহু বছর পরে বুঝতে পারবেন, সলিল চৌধুরী ভারতীয় আধুনিক সঙ্গীতের আত্মার কত বড় ধারক ছিলেন।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)