(বাঁ দিক থেকে) টোটা রায়চৌধুরী, মনামী ঘোষ, সাহেব ভট্টাচার্য এবং সৌমিতৃষা কুন্ডু। ছবি: সংগৃহীত।
দীপাবলির রাতের আকাশ আলো করে থাকে আতশবাজি এবং ফানুস। সময়ের সঙ্গে বাজি নিয়ে নানা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়েছে। আবার কালের নিয়ম মেনে বাজির রকমফেরও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু, কালীপুজোর সন্ধ্যায় এখনও বাঙালিদের একাংশ বাজি পোড়ায়। বাজি নিয়ে টলিপাড়ার তারকাদেরও নানা স্মৃতি রয়েছে।
অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী এখন বাজি নিয়ে বিশেষ একটা উৎসাহী নন। তবে শৈশবে কালীপুজোর দিন বাজি পোড়ানোর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতেন অভিনেতা। বললেন, ‘‘আট থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত আমি বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করতাম। সেখানে তো বাজি পোড়ানোর চল ছিল না। কিন্তু, তার পরে কলকাতায় ফিরে নতুন করে বাজি পোড়ানো শুরু করেছিলাম।’’
যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন টোটা। কালীপুজোর দিন ছোটকাকার কিনে আনা বাজির স্মৃতি আজও তাঁর মনে অমলিন। তবে অল্প বয়সে শব্দবাজির প্রতিই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। টোটা বললেন, ‘‘এক বার বাজি পোড়াতে গিয়ে কাকার হাত পুড়ে যায়। তার পর দাদু এবং ঠাম্মি ছোটকাকার উপরে খুবই রাগ করেন। তার পর থেকে বাড়ির ছোটদের উপর কড়া নজর রাখা হত।’’
টোটার বিশ্বাস, যে কোনও অপরিচিত পরিবর্তে পরিচিত দোকান থেকে বাজি কিনলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কারণ, বাজিকে ঘিরে খারাপ স্মৃতিও রয়েছে টোটার। আট বছর আগে মেয়ের সঙ্গে তুবড়ি জ্বালাতে যান টোটা। আগুন লাগতেই সেটা ফেটে যায়। বেশ আহতই হন টোটা। অভিনেতা বললেন, ‘‘হাতের সেই ছবিটা এখনও রেখে দিয়েছি। এক মাস সময় লাগে ঠিক হতে।’’ কিন্তু, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমস্যায় পড়েন টোটা। কারণ, সেই সময় ‘কহানি ২’-এর শুটিং শুরু করার কথা তাঁর। এ দিকে হাতের ওই অবস্থা! টোটা বললেন, ‘‘শেষে শুটিং তো শুরু করলাম। কিন্তু, মেকআপের মাধ্যমে হাতের দাগ আমাকে আড়াল করতে হয়েছিল।’’
শৈশবে শব্দবাজি ফাটালেও বয়সের সঙ্গে সেই পথ ত্যাগ করেছেন টোটা। আইন থাকা সত্ত্বেও কিন্তু দীপাবলির সময়ে শব্দবাজির দৌরাত্ম্য টোটাকে কষ্ট দেয়। এই ঘটনা মেনে নিতে পারেন না অভিনেতা। বললেন, ‘‘সে দিনও রাতে শব্দবাজিতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে! আমার তো মনে হয়, এই ধরনের ঘটনা যাঁরা ঘটান, তাঁদের জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করা উচিত।’’
এখন বাজি ‘ফাটানো’র তুলনায় ‘পোড়ানো’তেই বিশ্বাসী মনামী ঘোষ। তবে দেশের বাড়িতে শৈশবের কাটানো দিনগুলো এখনও মনে পড়ে তাঁর। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন মনামী। কালীপুজোর দিন তাঁর বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হত। ভাইফোঁটা পর্যন্ত বাড়িতে আত্মীয়- পরিজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। মনামী বললেন, ‘‘বাড়ির ছাদ এবং উঠোনে একসঙ্গে আমরা বাজি পোড়াতাম। আমার কাকারা বাজি ফাটাতে খুব পছন্দ করতেন। আর আমরা ছোটরা খুব ভয় পেতাম।’’ দুর্গাপুজোয় ক্যাপ বন্দুক দিয়ে শুরু। কালীপুজোয় রকমারি বাজি পোড়ানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে দিয়ে শেষ হত অভিনেত্রীর বাজি সফর।
শৈশবের দিনগুলো এখনও মনে পড়ে মনামীর। তবে এখন আর তিনি বাজি পোড়ান না। সেই সময় কালীপুজোর দিনে তাঁর বাড়িতে পরিবারের প্রায় ৫০ জন সদস্যের উপস্থিতি। সকাল থেকে পুজোর প্রস্তুতি এবং তার পর পুজো মিটতেই ভাইফোঁটার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত।
কলকাতায় চলে আসার পর নিজের বাড়িতে কালীপুজোর দিন লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করেন মনামী। ইন্ডাস্ট্রির বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির ছাদে বাজি পোড়াতেন তিনি। মনামী বললেন, ‘‘আমি ওদের মিষ্টির পরিবর্তে বাজি নিয়ে আসতে অনুরোধ করতাম। তবে, সেখানে কোনও শব্দবাজি থাকত না।’’ মনামী জানালেন, সময়ের সঙ্গে বাজি এখন তাঁর কাছে নিয়মরক্ষার সমান। একটা ফুলঝুরি বা রংমশাল জ্বালাতে পারলেই তিনি খুশি। এখন আলোর মাধ্যমেই দীপাবলি উদ্যাপন করেন মনামী। বললেন, ‘‘চোদ্দো প্রদীপ জ্বালাই। সারা বাড়ি নানা আলো দিয়ে সাজানো হয়। এটাই আমার কালীপুজো এবং দীপাবলি।’’
অভিনেতা সাহেব ভট্টাচার্য বাজি থেকে নিজেকে দূরেই রাখেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস, বয়স এবং পরিবেশগত কারণে বাজির থেকে তাঁর দূরত্ব বেড়েছে। বললেন, ‘‘অন্যের সমস্যা করে আমি নিজে আনন্দ করায় বিশ্বাসী নই। দূষণ বেড়েছে। আমার অনেক বন্ধুদের শ্বাসকষ্টে ভোগে। এই সব দেখে আমি আর বাজি পোড়াই না।’’
তবে শৈশবে তাঁদের বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি পোড়ানোর স্মৃতি আজও মনে রয়েছে সাহেবের। সকলে মিলে নুঙ্গি থেকে বাজি কিনে আনতেন। বললেন, ‘‘সারা পাড়ার বন্ধুরা আসত। ছাদে খাবারের আয়োজন করতেন মা। আর গভীর রাত পর্যন্ত বাজি পোড়াতাম আমরা।’’ সাহেবের কোন বাজি সবচেয়ে প্রিয় ছিল? হেসে বললেন, ‘‘চকোলেট বোম কোনও দিনই প্রিয় ছিল না। কিন্তু, কালীপটকার লম্বা মালাগুলো ফাটাতাম। তা ছাড়া বড় বড় শেল তো ছিলই।’’ ১৭ নভেম্বর সাহেবের জন্মদিন। তাই কালীপুজোর রয়ে যাওয়া বাজি জন্মদিনেও পোড়াতেন অভিনেতা। সাহেবের কথায়, ‘‘পুরো শীতকালটাই একটু একটু করে বাকি বাজিগুলো পুড়িয়ে শেষ করতাম আমরা।’’
সাহেবের দীপাবলি এখন প্রদীপে সুসজ্জিত। অভিনেতার কথায়, ‘‘কোনও শপিং মল নয়, স্থানীয় দোকান থেকে কয়েকশো মাটির প্রদীপ কিনে আনি। ছাদ এবং বারান্দা প্রদীপ দিয়ে সাজাই।’’ সারা বছর কাজের ব্যস্ততা থাকলেও উৎসবের দিনগুলো উদ্যাপনের চেষ্টা করেন সাহেব। বললেন, ‘‘কাজের জন্য তো সারা বছর পড়েই রয়েছে। এগুলো তো বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। তাই পরিবারের সঙ্গেই কাটানোর চেষ্টা করি।’’
বাজির কথা বললেই শৈশবের স্মৃতি বেশি ভিড় করে অভিনেত্রী সৌমিতৃষা কুন্ডুর মনে। ছোটবেলায় বাবার কিনে দেওয়া বাজি এবং তা পোড়ানোর জন্য নিয়ম করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা আজও মনে পড়ে অভিনেত্রীর। পরিবারের তরফে, ঝুঁকি নেই এ রকম বাজিই বেশি পোড়ানোর অনুমতি পেতেন সৌমিতৃষা। বললেন, ‘‘অফিস থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে বাজি কিনতে বেরোতাম। আর ছুটি থাকলে মা-বাবার সঙ্গে আমি সকালেই বাজি কিনতে যেতাম। তার পর বাজিগুলোকে রোদে রাখা আর সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকা...।’’
তবে উৎসবের দিনে কাছের মানুষ সঙ্গে না থাকলে উদ্যাপনের আনন্দ ফিকে হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করেন সৌমিতৃষা। কালীপুজোর দিনেও তাঁর সে রকমই মনে হয়। কারণ, কয়েক বছর আগে দিদাকে হারিয়েছেন অভিনেত্রী। শৈশবে বাজি পোড়ানোর সময়ে অভিনেত্রীর সঙ্গী ছিলেন দিদা। সৌমিতৃষা বললেন, ‘‘কাছের মানুষগুলো তারাদের দেশে থাকলে তখন সাজানো তারাগুলো আর ভাল লাগে না।’’ দিদাকে হারানোর পর তাই আর সে ভাবে বাজি পোড়ান না অভিনেত্রী।
এখন শুধুই পেশাগত দায়বদ্ধতার কারণে বাজি পোড়ান সৌমিতৃষা। কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে হয়তো বাজি পোড়াতে হল, এই রকম আর কি! কিন্তু জানালেন, কাজের প্রয়োজনে বাজি পোড়াতে হলেও সেখানে মনের আনন্দ থাকে না। কারণ, বাজি দেখলেই দিদার কথা মনে পড়ে অভিনেত্রীর। এখন বাজি না পোড়ালেও আলোর মাধ্যমে দীপাবলি উদ্যাপন করেন সৌমিতৃষা। বললেন, ‘‘বাড়িতে একটু লাইট দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করি। মায়ের সঙ্গে মোমবাতি জ্বালাই।’’