নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ছবি: সংগৃহীত।
গত এক দশক ধরে তাঁর ‘নিরঙ্কুশ’ ক্ষমতা দেখেছে দেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশাপাশিই তাঁর দফতর (পিএমও)-র বিপুল ক্ষমতা এবং প্রভাবও আলোচনায় এসেছে বার বার। কেন্দ্রে প্রথম বার জোট সরকারের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁর দফতর সেই ‘কর্তৃত্ব’ বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কোনও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্তের আগে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করতেন বলে তাঁর আমলের আমলা জগৎ সিং মেহতা লিখেছিলেন। নেহরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের আগে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পরামর্শ করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ‘চকিতে এবং একক ভাবে’ নিতেন বলে তার অন্যতম উপদেষ্টা পৃথ্বীনাথ ধর একদা দাবি করেছিলেন। মোদী যে কার পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন এবং কার আপত্তিতে কর্ণপাত করেন, এক দশক পরেও তা নিয়ে ‘রহস্য’ রয়েছে সরকার এবং দলের অন্দরেই।
অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের নেপথ্যেই যে পিএমও-র ‘দীর্ঘ ছায়া’ রয়েছে, একাধিক বার তা জানিয়েছেন বিজেপির অনেক নেতাই। বিভিন্ন সময়ে মোদী এবং পিএমও-র ‘তৎপরতা’তেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের দায়িত্বপাপ্ত মন্ত্রীদের কার্যত অন্ধকারে রেখেই নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে পিএমও-র বিরুদ্ধে। বিশেষত, প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের এড়ানোর অভিযোগ উঠেছে একাধিক বারেই। এ ক্ষেত্রে অনিবার্য ভাবে চলে এসেছে মোদীর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নাম।
বিদায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিদায়ী প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে ডোভালের সম্পর্ক ‘মসৃণ’ নয় বলেই বিজেপির একটি অংশের দাবি। তবুও ২০১৪ সালের মে মাস থেকে টানা এক দশক ওই পদে বহাল রয়েছেন তিনি। ২০২০ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধী বিক্ষোভ থেকে গোষ্ঠীহিংসা ছড়িয়েছিল দিল্লির শাহিনবাগ এবং আশপাশের কিছু এলাকায়। অভিযোগ উঠেছিল, শাহের মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশের উপর ভরসা নেই বলেই সে সময় পিএমও-র তরফে ডোভালকে পাঠানো হয়েছিল এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য।
২০১৯-এ পুলওয়ামায় লস্কর-ই-তৈবার হামলার পরে বালাকোটে বিমানহানা এবং ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে জম্মু-কাশ্মীরে অশান্তি ঠেকাতেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ডোভালকে। রাজনাথকে ‘ব্রাত্য’ করার জল্পনাও দানা বেঁধেছিল। ২০২০ সালে বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের অনুপস্থিতিতেই তাঁর দফতরের আমলা এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মোদী-সহ পিএমও-র আধিকারিকেরা। বিরোধীরা খোঁচা দিয়ে বলেছিল, নির্মলাকে ‘নির্বলা’ (‘বল’ বা শক্তিহীন) করতে চাইছেন মোদী এবং তাঁর দফতর।
এমনকি, মোদী মন্ত্রিসভার আর এক সিনিয়র মন্ত্রী তথা প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী কয়েক বছর আগে পিএমও-র নাম না করে বলেছিলেন, ‘‘মনে রাখা উচিত, অসত্য কথা বললে জনতা পেটাতেও পারে।’’ আর সহযোগী দলের মন্ত্রীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আচরণ? বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের প্রতিবাদে ২০২০-র সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে শিরোমণি অকালি দলের নেত্রী হরসিমরৎ কউর বাদল অভিযোগ করেছিলেন, মন্ত্রিসভাকে অন্ধকারের রেখে বিলের খসড়া তৈরি হয়েছে!
বস্তুত, খাতায়কলমে বিভিন্ন মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা থাকলেও এত দিন পর্যন্ত কার্যত মোদী একাই সব দফতরের ভার সামলেছেন বলে দলের একটি অংশ জানাচ্ছে। কেন্দ্রের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সম্প্রতি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, বিপুল কাজের চাপ সামলাতে আক্ষরিক অর্থেই রাতের ঘুম উবে গিয়েছে মোদীর। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শয্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মেরেকেটে ঘণ্টা চারেকের!
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে, এ বার কেন্দ্রে শরিক-নির্ভর হতে হবে মোদীকে। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২। বিজেপি একক ভাবে জিতেছে ২৪০টিতে। তাদের নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ২৯২টি আসনে জিতেছে। ১৬ এবং ১২টি আসনে জিতে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে উঠেছেন এনডিএ-র দুই সহযোগী নেতা তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র প্রধান চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং জেডিইউ সভাপতি নীতীশ কুমার। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দাবিতে তাঁরা বিজেপির উপর চাপ বাড়িয়েছেন বলে ‘খবর’। ফলে আগামী দিনে কেন্দ্রীয় সরকারে পিএমও-র ‘একাধিপত্য’ খর্ব হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তবে দলেরই আর এক অংশের দাবি, এক দশকের ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া’ প্রতিহত করে নেহরুর পরে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তৃতীয় ‘ইনিংস’ শুরু করতে চলেছেন মোদী। দল এবং সহযোগীদের মধ্যে তাঁর উচ্চতার সঙ্গে তুলনীয় কোনও নেতাও নেই। ফলে পিএমও-র ‘প্রভাব’ অটুট থাকারই সম্ভাবনা।
(এই প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল, দু’টি মনোনীত আসন-সহ লোকসভার মোট আসন ৫৪৫টি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭৩টি আসন। এই তথ্য সঠিক নয়। ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষে লোকসভায় দুই মনোনীত সাংসদ রাখার আইনটি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল হয়ে গিয়েছে। ফলে নির্বাচিত ৫৪৩ জন সাংসদকে নিয়েই এখন পূর্ণাঙ্গ লোকসভা। ক্ষমতা দখলের জাদুসংখ্যা ২৭২। এই তথ্যগত ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী)