—প্রতীকী চিত্র।
লোকসভা ভোটে বাংলার শহর এলাকায় তৃণমূলের থেকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বিরোধী বিজেপি। লোকসভা ভোটের ফলাফল পুরসভাওয়াড়ি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি এবং তৃণমূলের ব্যবধান চোখে পড়ার মতো। বাংলার ১২১টি পুরসভার মধ্যে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ৬৯টি পুরসভা এলাকায়। ধুলিয়ান এবং বহরমপুর পুরসভায় এগিয়ে রয়েছে কংগ্রেস। বাকি ৫১টিতে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল।
গ্রামীণ ভোটে তৃণমূলের ‘আধিপত্য’ থাকলেও দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ— পুর এলাকায় বিজেপির পক্ষে সমর্থন বেশি। যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলেও। লোকসভা ভোটের প্রাক্কালেই রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল-বিরোধিতার ঘটনাক্রম দেখা গিয়েছিল। চাকরি বাতিল থেকে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগের ঘটনায় রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, লোকসভা ভোটে এর কতটা প্রভাব পড়বে? সার্বিক ভাবে দেখা গিয়েছে, রাজ্যে ভোট এবং আসন দুই-ই বেড়েছে তৃণমূলের। সেই অর্থে নিয়োগ দুর্নীতি বা ওই সংক্রান্ত বিষয়গুলির কোনও প্রভাব পড়েনি। কিন্তু গভীরে নিবিড়ে গিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, পুর এলাকায় সমর্থন আলগা হয়েছে তৃণমূলের। যদিও গ্রামীণ এলাকার বাড়তি সমর্থন সেই ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দিয়েছে।
লোকসভা ভোটে তৃণমূল স্তরে যাঁরা দলের হয়ে কাজ করেছিলেন, সেই নেতাদের একাংশ বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ স্তরে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের বক্তব্য, গ্রামে না-হলেও শহরাঞ্চলে নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি বা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়িতে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার ঘটনা ‘কুপ্রভাব’ ফেলেছে। আবার অন্য অনেকের মতে, এই ভোট লোকসভার ভোট। দেশের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার ভোট। তাঁদের মতে, শহুরে ভোটারদের একটা বড় অংশ নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়ে ভোট দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের আবেদন ততটা কাজ করেনি। কারণ যা-ই হোক, লোকসভা ভোটের ফলাফলে এই তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে যে, সারা রাজ্যে ৫০ শতাংশের বেশি পুরসভা এলাকায় বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে যে তথ্য শাসক তৃণমূলের পক্ষে খুব ‘স্বস্তিদায়ক’ নয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের ১২১টি পুরসভায় ভোট হয়েছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, নদিয়ার তাহেরপুর বাদ দিয়ে বাকি ১২০টি পুরসভাই জিতেছে তৃণমূল। তাহেরপুর ছিল সিপিএমের দখলে। কিন্তু এই লোকসভা ভোটে দেখা যাচ্ছে, সেই হিসেব উল্টে গিয়েছে। বালুরঘাট থেকে ঘাটাল, খড়্গপুর থেকে বাঁশবেড়িয়া— পুর এলাকায় পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। অধিকাংশ ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।
‘কর্পোরেশন’ এলাকাগুলিতে আবার সব জায়গায় ফলাফল এক নয়। যেমন শিলিগুড়ি, আসানসোল, বিধাননগরের অধিকাংশ এলাকায় এগিয়ে বিজেপি। আবার হাওড়া, কলকাতায় এগিয়ে তৃণমূল। কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৫টি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। দু’টি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে সিপিএম। একাধিক মেয়র পারিষদ সদস্য, বরো চেয়ারম্যানদের ওয়ার্ডেও কলকাতায় তৃণমূলের থেকে বিজেপির ভোট বেশি। তা যেমন উত্তর কলকাতায়, তেমনই দক্ষিণ কলকাতাতেও।
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ, রাসবিহারীর বিধায়ক তথা দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের জেলা সভাপতি দেবাশিস কুমারের নিজের ওয়ার্ডেও পিছিয়ে রয়েছে শাসকদল। শহরাঞ্চলে কেন এমন হল? দেবাশিস কলকাতার প্রসঙ্গে বলেন, “যদি ২০১৯ এবং ২০২৪-এর ফলাফল পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষণ করা যায়, তা হলে দেখা যাবে পাঁচ বছর আগেও লোকসভা ভোটে কলকাতায় এই ধরনের ফলাফল হয়েছিল। কিন্তু তা বিধানসভা বা কর্পোরেশন ভোটে দেখা যায়নি। গত লোকসভায় কলকাতার যে যে ওয়ার্ডে বিজেপি যত ভোটে এগিয়ে ছিল, এ বার সেই ব্যবধানও কমেছে।” তাঁর কথায়, “লোকসভার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাই এটা হয়। কিন্তু বিধানসভা বা পুরসভা ভোটের সময়ে এটা উল্টে যায়।”
গত লোকসভা ভোটে আসানসোল আসনটি জিতেছিল বিজেপি। তার পরে সেখানকার সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যোগ দেন এবং সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। উপনির্বাচনে জেতেন শত্রুঘ্ন সিন্হা। এ বারেও তিনিই জিতেছেন। কিন্তু আসানসোল পুর এলাকায় বিপুল ভোটে পিছিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। কেন এই ফল হল, সে প্রশ্নের জবাবে আসানসোলের মেয়র তথা বরাবনির বিধায়ক বিধান উপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা হেরেছি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমি কোনও অজুহাত দেব না। আমাদের আরও ভাল করে কাজ করতে হবে। কেন পিছিয়ে রইলাম, সেটাও খুঁজে বার করতে হবে।"
হুগলি লোকসভা আসনটি এ বার বিজেপির থেকে তৃণমূল ছিনিয়ে নিলেও বাঁশবেড়িয়া, চুঁচুড়ার মতো পুরসভায় তৃণমূলের থেকে পদ্মশিবির এগিয়ে। মফস্সলের পুরসভা এলাকায় এই চিত্র কেন? বাঁশবেড়িয়া পুরসভার চেয়ারম্যান আদিত্য নিয়োগী মনে করেন, “সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচার আমাদের ক্ষতি করেছে। শহরের লোক খবর দেখে, খবর পড়ে। গ্রামের লোক পড়ে না। মিডিয়ার একাংশ যে প্রচার করেছিল, তার প্রভাব পড়েছে। সেই সঙ্গে জুটমিল এলাকার অবাঙালি ভোট এবং মতুয়া ভোট আমরা সে ভাবে পাইনি।” তবে আদিত্যেরও দাবি, ২০১৯ সালের তুলনায় ফল ভাল হয়েছে।
অনেকের মতে, শহরাঞ্চলে ভোটের ফলাফলে কেন তৃণমূলের থেকে বিজেপি এগিয়ে রইল, তা একটি বা দু’টি কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকায় অবাঙালি হিন্দু ভোট গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে। ১০৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭০টিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। আবার অবাঙালি হিন্দু ভোটের আধিক্য রয়েছে হাওড়া কর্পোরেশনের যে অসংখ্য ওয়ার্ডে, সেখানে তৃণমূল জয় পেয়েছে। বাঁশবেড়িয়ার জুটমিল এলাকার ভোট যেমন বিজেপির দিকে গিয়েছে, তেমনই একই জেলার চাঁপদানি, ভদ্রেশ্বর, রিষড়ার জুটমিল এলাকার ভোট পেয়েছে তৃণমূল। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সংখ্যালঘু ভোট সর্বত্রই তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। সেখানে এলাকাবিশেষে কোনও তারতম্য নেই। ঘটনাচক্রে আদিবাসী ভোটও এলাকা অনুযায়ী সমীকরণ বদলেছে। ঝাড়গ্রামে দেখা গিয়েছে, আদিবাসী ভোট তৃণমূলের পক্ষে। পুরুলিয়ায় সেই ভোট গিয়েছে বিজেপির পক্ষে। একমাত্র সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষেত্রে এমন কোনও রদবদল হয়নি।
তৃণমূলের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, পুরসভা ভোটের সময়ে স্থানীয় স্তরে কাউন্সিলরেরা যে ভাবে ঝাঁপান, লোকসভার সময়ে অনেক ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। সে কারণেও শহরাঞ্চলের ভোটের এই ছবি দেখা যাচ্ছে। তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “কাউন্সিলরেরা নিজেদের ভোটে যে ভাবে নিজস্ব পরিশ্রম বা সংগঠন উজাড় করে দেন, লোকসভায় অধিকাংশ জায়গায় তা দেখা যায় না। যায়নি। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ আর দলীয় স্বার্থের সংঘাত স্পষ্ট। এ নিয়ে দলের মধ্যেও আলোচনা চলছে। জেলাগত ভাবে পর্যালোচনার পরিকল্পনাও রয়েছে।”
আবার যাঁরা পুর-রাজনীতিতে পোড়খাওয়া, তাঁদের বক্তব্য, লোকসভায় ‘ভিন্ন’ প্রেক্ষাপটে ভোট হয়। বিধানসভা বা পুরসভায় তা নয়। তখন রাজ্য সরকার ও স্থানীয় স্তরের পরিষেবাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে কলকাতার দেবাশিস কুমার থেকে বাঁশবেড়িয়ার আদিত্য নিয়োগীর সুর এক। তবে দলগত ভাবে তৃণমূল সারা রাজ্যেই শহুরে ভোটের ফলাফল নিয়ে ময়নাতদন্তের চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। ২০২৬ আসতে আর দু’বছর!