Lok Sabha Election 2024

কলকাতায় পিছিয়ে থাকা ৪৭ ওয়ার্ডে হারের কারণ অনুসন্ধান করবে তৃণমূল, নজরে কিছু কাউন্সিলরও

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরনির্বাচনে কলকাতার ১৩২টি ওয়ার্ড জিতে নিয়েছিল তৃণমূল। আড়াই বছরের ব্যবধানে কেন কলকাতার একটি অংশের ভোটারেরা মুখ ফিরিয়েছেন, তার তদন্ত হবে দলের অন্দরে।

Advertisement

অমিত রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৪ ১২:৪৯
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিকে) এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার দু’টি আসনেই জিতেছে তৃণমূল। কিন্তু কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৭টিতে পিছিয়ে পড়েছে রাজ্যের শাসকদল। অথচ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরনির্বাচনে কলকাতার ১৩২টি ওয়ার্ডই জিতে নিয়েছিল তৃণমূল। মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে কেন কলকাতার ভোটারদের একাংশ মুখ ফেরালেন, তা নিয়ে মন্থন শুরু হয়েছে শাসক শিবিরে।

Advertisement

তৃণমূল সূত্রের খবর, গত শনিবারের বৈঠকে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য বিশেষ ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে। সেই নির্দেশ পাওয়ার পরেই সেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। কলকাতা পুরসভার শেষ নির্বাচনে তৃণমূল যেমন ১৩২টি ওয়ার্ডে জিতেছিল, তেমনই তিনটি ওয়ার্ডে বিজেপি, দু’টি ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট, দু’টি ওয়ার্ডে কংগ্রেস এবং তিনটি ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। পরে জয়ী নির্দলেরা তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু এ বার কলকাতা পুর এলাকার ফলাফলের ‘প্রবণতা’ অন্য রকম।

দলের নেতাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, এর মধ্যে স্থানীয় ভোট এবং দেশের ভোটের মানসিকতা জনিত কারণ রয়েছে। দলের এক প্রবীণ সাংসদের কথায়, ‘‘এটা শহরাঞ্চলে বরাবর হয়ে থাকে। আর এ বারের ভোটে এটাও মনে হয়েছে যে, শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের একটি অংশ নরেন্দ্র মোদীকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার দেখতে চেয়েছিলেন। আসল পুরভোটে এটা হবে না। কিন্তু তবু আমাদের এই ফলাফলের বিশ্লেষণ করে তার কারণ খুঁজে বার করতে হবে।’’

Advertisement

কলকাতা পুরসভার নিরিখে এই ফলাফল সম্পর্কে প্রশ্ন করায় কাশীপুর-বেলগাছিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক তথা কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বলেন, ‘‘ফলাফল নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে কিছু বলার মতো সময় আসেনি। তবে সার্বিক ভাবে কলকাতার ফলাফল আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। কোন ওয়ার্ডে কী ফল হয়েছে, তার প্রত্যেকটির ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দলের অভ্যন্তরে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরেই প্রকাশ্যে কিছু বলা সম্ভব।’’

দক্ষিণ কলকাতার এক প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘সব ওয়ার্ডে হারের কারণ এক হতে পারে না। কোনও ক্ষেত্রে একটি ওয়ার্ডে ভোটারেরা হয়তো লোকসভা ভোটে দিল্লির দিকে তাকিয়ে ভোট দিয়েছেন। কোথাও আবার স্থানীয় পুর পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভের কারণে মানুষ বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ ভাবে ফলাফল বিশ্লেষণ না করলে স্পষ্ট উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়।’’

ফলাফলের বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনায় স্থানীয় কাউন্সিলরের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেমন কলকাতা পুরসভার ১৬ নম্বর বরোর অন্তর্গত ১২৩ এবং ১২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিরোধী বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে শাসক তৃণমূল। বড়িশা ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের ওই দু’টি ওয়ার্ডে এমন ফল প্রসঙ্গে বরো চেয়ারম্যান সুদীপ পোল্লে বলেন, ‘‘বুথভিত্তিক ফলাফল দেখার পর আমাদের মনে হয়েছে, ওই দু’টি ওয়ার্ডে কেআইপি-র কাজের জন্য সাধারণ মানুষকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। যে সব এলাকার মানুষ সমস্যায় পড়েছিলেন সে সব এলাকার ভোট আমাদের বিপক্ষে গিয়েছে। তবে ভোট বিরুদ্ধে যাওয়ার আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। স্থানীয় সমস্যা বা জাতীয় ইস্যু— যে কোনও ক্ষেত্রেই মানুষের মতামত বিপক্ষে কেন গেল, তা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে দলকে জানাব। পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে বলার মতো সময় আসেনি।’’

কলকাতা পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতা, যাদবপুর, ডায়মন্ড হারবার লোকসভায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। লোকসভা ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, উত্তর কলকাতার ২৪টি ওয়ার্ডে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। ৩৬টি ওয়ার্ডে এগিয়ে থাকায় তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জয় নিশ্চিত হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে ২০টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি। এ বার আরও চারটি ওয়ার্ডে এগিয়েছে তারা। উত্তর কলকাতার কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভার ২ এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। শ্যামপুকুর বিধানসভায় ৮, ২১, ২৪ এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছে বিজেপি। জোড়াসাঁকো বিধানসভার ২২, ২৩, ২৫, ২৭, ৩৮, ৪০, ৪১, ৪২ এবং ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে আছেন বিজেপির প্রার্থী তাপস রায়। চৌরঙ্গি বিধানসভার ৪৫, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১ এবং ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে আছে বিজেপি।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতার ২৬টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু এ বারের লোকসভা ভোটে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ২০। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের পাঁচটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। ৬৩, ৭০, ৭১, ৭২ এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নিজের নিজের এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণ জানার চেষ্টা শুরু করেছেন বলেই দলের একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ভবানীপুর বিধানসভার তৃণমূল নেতৃত্ব জানতে পেরেছেন, ওই ওয়ার্ডগুলির অন্তর্গত আবাসনের ভোট মূলত তাঁদের বিপক্ষে গিয়েছে।

গত লোকসভা নির্বাচনে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কেন্দ্র বেহালা পশ্চিমের তিনটি ওয়ার্ডে এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। ১১৮, ১১৯ এবং ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডে পিছিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু এ বার শুধু ১১৯ নম্বর ওয়ার্ডেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। কসবা বিধানসভার ৬৬ এবং ৯১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এগিয়ে শাসকদল। শুধু ৬৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই এসেছে ৫০ হাজারের ব্যবধান। বাকি ৬৭, ৯২, ১০৭ এবং ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে। কলকাতা বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। রাসবিহারী বিধানসভার ৮১, ৮৬ , ৮৭ এবং ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডে পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। বেহালা পূর্ব বিধানসভার ১১৬ এবং ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।

ডায়মন্ড হারবার লোকসভার অন্তর্গত মেটিয়াবুরুজ বিধানসভার মধ্যে কলকাতা পুরসভার ১৩৬-১৪১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিরাট ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। ওই কেন্দ্রের একটি ওয়ার্ডেও দাঁত ফোটাতে পারেনি কোনও বিরোধী দল।

তবে যাদবপুর লোকসভার অন্তর্গত দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের কয়েকটি ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে সিপিএম এবং বিজেপি দু’পক্ষই। যেমন টালিগঞ্জ বিধানসভার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫৫ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন সিপিএমের প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। যাদবপুর বিধানসভার ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডেও ২০১ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন সিপিএম প্রার্থী। ওই বিধানসভার ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৯২১ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন বিজেপি প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী ১৪১ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।

(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল বেহালা পূর্ব বিধানসভার ১১৬ এবং ১১৮ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। সেটি ভুল। বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ১১৬ এবং ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement